মিল্টন বিশ্বাস


 

চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আদর তঞ্চঙ্গ্যা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পুড়ে জ্বলছে রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলা!! অনিশ্চিত ভবিষ্যত...অনিশ্চিত আমাদের জীবন!! প্লিজ চোখ খুলুন, এগিয়ে আসুন...’ আদর আরো লিখেছেন, ‘আজ যেসব ফল আমরা ভোগ করছি স্বীকার করতে হবে সব নেতাদের ব্যর্থতার দায়। তাদের দুর্বল মানসিকতা, মাথা নত করা, দূরদর্শী চিন্তার অভাব, নেই একাগ্রতা, প্রতি পদক্ষেপে ব্যর্থতা, এসব কারণেই আজ আমরা বিলীন হয়ে যাওয়ার সম্মুখীন।

মোটকথা, গাছটাকে যেভাবে রোপণ করেছি বড় করেছি ফলও ঠিক সেভাবে পাচ্ছি। যে যাই বলুক, ২রা ডিসেম্বর (১৯৯৭) ওটা কখনো আমাদের অস্তিত্বের চুক্তি ছিল না কারণ চুক্তির ফল কখনো এমন হতে পারে না। আজ আমরা নিজ দেশে পরবাসী!! তাহলে চুক্তির অর্থ কি?!!’ ২ জুন(২০১৭) রাঙামাটির লংগদুতে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা নিহতের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল থেকে পাহাড়িদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আদর তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এভাবে। ওই মিছিল থেকে পাহাড়িদের আড়াইশর বেশি বসতঘর ও দোকানপাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাড়িঘরে আগুন দেওয়ার পর স্থানীয় পাহাড়িরা আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন- এ দৃশ্যও আমরা ফেসবুক সূত্রে তাৎক্ষণিক পেয়েছি। তবে আদর তঞ্চঙ্গ্যার ক্ষোভ শান্তি চুক্তির ফলাফল নিয়ে হলেও সেই চুক্তির নেতৃত্বে থাকা শেখ হাসিনার সদিচ্ছা যে এখনো তাৎপর্যবহ সেটা স্বীকার করতে হবে নির্দ্বিধায়। কারণ তাঁর শান্তি প্রচেষ্টায় পার্বত্য এলাকার সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সম্পন্ন হয়েছে। কারণ তিনি অনেক আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মঙ্গল চিন্তায় নিবেদিতপ্রাণ। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সহাবস্থানের রাজনীতি। শেখ হাসিনার রাজনীতি সুবুদ্ধি দিয়ে টিকে থাকার রাজনীতি। হিংসা, বিদ্বেষের রাজনীতি, ধর্মের রাজনীতি চালু করে গেছেন মরহুম জিয়াউর রহমান, তা চালু রেখেছে জামায়াত ইসলাম। বিএনপি, জামায়াতের হিংসাত্মক, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ থেকে বের হয়ে আসার সময় অনেক আগেই তৈরি করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা।

২. যুবলীগের নেতার হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু সেই ঘটনার জন্য সকল পাহাড়িকে দগ্ধ করার কোনো অধিকার বাঙালিদের নেই। তিনটিলা এলাকার বাসিন্দা ও উপজেলা জনসংহতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনিশংকর চাকমা বলেছেন, ‘আমাদের পাড়ার একটি ঘরও অবশিষ্ট নেই। দুই শতাধিক বাড়িঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘এই হত্যার ঘটনার সঙ্গে তো আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, আমরা তো কিছুই জানি না। তবুও কেন আমাদের বাড়িঘর আগুনে পোড়ানো হলো, জানি না।’ রাজনৈতিক সহিংসতার কথা মাথায় রেখেও বলা চলে সহজ-সরল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য বাঙালিদের বিবেচনা বোধকে আরো তীব্র করতে হবে। বুঝতে হবে সেখানকার কৃষি নির্ভর মানুষগুলো নিজদেশে যেন পরবাসীর মতো বসবাস না করে। তারা যেন বাঙালিদের বিশ্বাস করে।

এজন্য দরকার শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন; আর শেখ হাসিনার চিন্তাধারায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত হওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম : শান্তির অন্বেষায়’ প্রবন্ধে ১৯৯৮ সালে লিখেছেন, ‘পাহাড়ে বসবাসকারী কি পাহাড়ি কি বাঙালি সকলেই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। শান্তি স্থায়ী করতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হবে।... শিক্ষায় স্বাস্থ্যকর্মে উন্নত সমাজ গড়তে পারলেই স্থায়ী শান্তি স্থাপন হবে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে শান্তির পক্ষে। সকলেই শান্তি চায়।’(শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র ১, পৃ ২৩৯) শান্তির এই প্রত্যয়কে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ধারণ করে শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পার্বত্য সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর। সেসময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ওই এলাকায় স্থায়ী বসবাসের জন্য অন্যান্য স্থান থেকে মানুষ স্থানান্তর করেন। সেই অনাকাঙ্খিত ঘটনা ছিল অগ্রহণযোগ্য।

তৎকালীন সরকারি প্রশাসন সমতল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের নদীভাঙ্গা ভূমিহীন, দিনমজুর, অসহায় দুস্থ পরিবারগুলোকে এনে সরকারি খাস ভূমিতে পুনর্বাসন করে। এই পুনর্বাসনের কয়েক বছর যেতে না যেতেই শান্তিবাহিনী নামক উপজাতীয় গেরিলারা সরকারের উপর প্রতিশোধ নিতে পুর্নবাসিত বাঙালিদের উপর হামলা চালায়। সুরক্ষিত ওই অঞ্চলে ভারতের জঙ্গিরা সহায়তা করত শান্তিবাহিনীদের। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের জড়িত হওয়াটা ছিল ব্যয়বহুল। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়েছে দৃঢ়চিত্তে। ৬ জন তরুণ অফিসার, ১ মেজর, ৩ ক্যাপ্টেন ও ২ লেফটেন্যান্টসহ ৩১২ জন সৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।

একইসঙ্গে অজস্র পাহাড়ি জনতা নৃশংসতার শিকার হন, মৃত্যুবরণ করেন। অবশ্য তাতে সেখানকার উন্নয়নের গতিধারা ব্যাহত হয়নি বর্তমান সরকারের আমলে। পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক হাজার কিলোমিটার রাস্তার অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত। নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশ-বিদেশী হাজার হাজার পর্যটক বান্দরবানের নীলগিরিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব স্পটে ছুটে যান তার পুরো অবদানটাই সেনাবাহিনীর। নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ও রাস্তা নির্মাণ না করা হলে রাত্রিযাপন করে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করা দূরের কথা, সেখানে কেউ যাওয়ার কল্পনাও করতেন না। বর্তমানে অপহরণ একেবারেই শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ভারতের সঙ্গে পুনরায় সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু কিছু অস্ত্র ব্যবসায়ী ও ধর্মীয় মৌলবাদীদের কারণে সেই সংঘাত এখনো জিইয়ে রাখা হয়েছে।

৩. শেখ হাসিনার সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের আশা-আকাঙ্খা ও প্রত্যাশা পূরণে সর্বদা সচেষ্ট। সেই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বর্তমান সরকারের কোনো অগণতান্ত্রিক ও জনবিরোধী উদ্যোগ নেই। গত মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ পেয়েছেন। ভূমি কমিশন গঠন ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের অখ্যতা রক্ষার জন্য উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ধারণা সবাই মেনে নিয়েছে। মূলত পাহাড়ি-বাঙালি দ্বন্দ্ব নিরসনে এবং পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ। বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের সব নাগরিকের কাছে প্রিয় এলাকা। পাহাড়ি উপজাতিরা যদি সমতলের বাঙালিদের সন্দেহের চোখে দেখে এবং অনুপ্রবেশকারী মনে করে, অন্যদিকে বাঙালিরা পাহাড়িদের হেয় প্রতিপন্ন করতে তৎপর হয় তাহলে তা হবে দেশের শান্তি প্রচেষ্টার জন্য আত্মঘাতী। এ জন্য কেবল শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও তাঁর শান্তি প্রচেষ্টায় আস্থা রাখা পার্বত্য এলাকার উভয় পক্ষের জন্য কল্যাণকর।

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, Email : [email protected]