মোঃ আরিফুল ইসলাম



কিছু প্রশ্ন ভিত্তিক আলোচনা করতে চাই।

ক. ৫৭ ধারা কি?
খ. ৫৭ ধারা আসার পূর্বের আলোচনা।
গ. কেনো করা হয়েছে ৫৭ধারা?
ঘ. ৫৭ ধারা কি আসলেই তার সঠিক কাজটি করতে পেরেছে?
ঙ. ৫৭ ধারার বাতিল দাবি করেছেন অনেকেই।কেনো?

রাষ্ট্র এবং আঈন

রাষ্ট্র একটি কাঠামো,একটি অঞ্চল,ভাষাগত,জাতিগত,কিংবা সাংস্কৃতিক একীভূত অঞ্চলকে একত্র করে একটি কাঠামোর দ্বারা পরিচালিত করার যে পদ্ধতি তাই রাষ্ট্র। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দুটি বিষয় জরুরি ১. সম্মতি ২. জবরদস্তি।

গণভোট,জনগনের সরাসরি কিংবা জনগনের প্রতিনিধি দ্বারা সম্মতির ভিত্তিতে পরিচলনাকে সম্মতি এবং রাষ্ট্রের জনগণকে ভীত,জোর করে ভয় দেখিয়ে প্রশাসন বা সরকারী বাহীনি দ্বারা নিয়ন্ত্রন করাটা জবরদস্তি।জবরদস্তির জন্যে দরকার হয় আঈন।সেই আঈন কখনো জনগনের পক্ষে বা ভালোর জন্যে হলেও জবরদস্তির জন্যে অনেকসময় গনবিরোধী বাক স্বাধীনতা বিরোধী আঈনও তৈরি করা হয়।সেরকমই একটা আঈন ৫৭ ধারা।

অনেকেই মনে করেন 'দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করলেই সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কিংবা আমাদের দেশে অনেক ভাল ভাল আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই।'
এখানে বলতে হয়; বিচার বিভাগ আইন তৈরি করে না, আইন অনুযায়ী বিচার করে। দেশের আইনগুলি যদি জনগণের পক্ষের না হয়, বিচার বিভাগ কি করতে পারবে? সংবিধানেই ১৪৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলের যাবতীয় আইন বলবৎ থাকবে। আচ্ছা বৃটিশ ও পাকিস্তানীরা কি আমাদের ন্যায়বিচার দেয়ার জন্য আইন করেছিল?

আইন করা হয়েছে জ্বালানি খাতে যে সমস্ত ক্রয় এবং চুক্তি হবে তা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বাজেট নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না, এমনকি যেকোন সাধারাণ বিল প্রেসিডেন্ট রিভিউ করার জন্য সংসদে ফেরত পাঠাতে পারেন 'অর্থবিল' ব্যতীত। ক্রস ফায়ারে যে সমস্ত মৃত্যু হবে তা নিয়ে আদালতে যাওয়া যাবে না। আইনেই বলা আছে একই অপরাধের জন্য সকল নাগরিককে একই আইনের আওতায় বিচার করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট ইচ্ছা করলে যে কোন অপরাধীর অপরাধ ক্ষমা করে দিতে পারবেন। আইনেই বলা আছে সরকার প্রধান কোনো কিছুর জন্যই কারও কাছে জবাবদিহি করবেন না।
বিচার বিভাগ শুধুমাত্র আইন মোতাবেক বিচার করতে পারবেন। সেই আইন ন্যায়ের সাথে সাংঘর্ষিক হলেও বিচার বিভাগ কিছু করতে পারবে না।

"সকল 'ভাল ভাল' আইন প্রয়োগের মাধ্যমেই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত। শাসকদের পক্ষে সুবিধাজনক এবং জনস্বার্থের বিপক্ষের আইন বহাল রেখে 'আইনের শাসন'ই প্রতিষ্ঠিত থাকবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না।"

৫৭ ধারা আসলে কি?

১. আলোচনায় যাবার আগে একটু দেখে নেয়ক দরকার ৫৭ ধারাটি আসলে কি?

কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। (দুই) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। এই হচ্ছে সেই ৫৭ ধারা।


৫৭ ধারার পূর্ব আলোচনা।

২. ৫৭ ধারার হামলাগুলো মূলত কেনো আনা হয়েছে সেটা বোঝাটা জরুরি, ২০১৩ তে গনজাগরন মঞ্চের আন্দোলনের পর থেকে সবচেয়ে বেশী আলোচিত বিষয় ছিলো ধর্মীয় অনুভূতি আর বিজ্ঞানভিত্তিক লেখকদের ব্লগ আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভীন্ন লেখালেখি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারন করা একঝাক তরুন সংগঠক আর বামপন্থী সংগঠনগুলোর সংঘটিত আন্দেলনটি যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শুরু হয়েছিলো।

আর যুদ্ধাপরাধীদের প্রায় সবাই ই কোন না কোনভাবে হয় সরাসরি ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রচারক,অথবা লালনকারী ছিলো।ফলে জনতা যেখানে আন্দোলনকে পরিচালিত হতে দেখেছে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে সেখানে কথিত ইসলামপন্থীরা ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ কারীদের মিলনমেলা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছে গনজাগরন মঞ্চের জাগরণকে। তারই ধারাবাহিকতায় কথিত ইসলামপন্থী উগ্র মতবাদী ধারার হেফাজত-ই-ইসলাম নামে সংগঠন ৫ই মে তে শাপলা চত্বরে ১৩ দফা আন্দোলন এর নামে দেশকে থমথমে পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবার ঘটনা মনে আছে নিশ্চয়। সেখানে সন্ধার দিকে প্রসাশন যখন হেফাজতীদের উঠে যেতে অনুরোধ করলো,তখন বিএনপির প্রচারণার কারণে সেই আন্দোলন সহিংস রুপ ধারন করলো,ফলাফল আমরা দেখলাম হেফাজতিরা বায়তুল মোকাররম এলাকায় ভাংচুর,কোরান পোড়ানোর মত কাজে লিপ্ত হলো। সেখানে রাতে প্রশাসন এর শক্ত অবস্থান গ্রহন করতে পারার কারণেই হেফাজতিদের শাপলা চত্বর থেকে উচ্ছেদ করা গিয়েছিলো।ঘটনার শেষ হয়তোবা সেদিনই হতে পারতো।কিন্ত আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার সেদিন হয়তোবা বেশ ভয়ই পেয়েছিলো বলেই ৫ই মে র পর থেকে স্বয়ং সরকারের হেফাজতিদের কাছে নমনীয়তার বিষয়টি খেয়াল করা গেছে। রেল অধিদপ্তরের জমি দানের বিষয়টি বেশ আলোচিত হয়েছে সেসময়।

এরমধ্যে বেশকজন বিজ্ঞানলেখক, ব্লগারকে হত্যা করে দূর্বৃত্তরা। ব্লগ, ফেসবুক টুইটারে ব্লগার এক্টিভিস্টদের লেখার বিরুদ্ধে টানা সমালোচনা করে যাবার মধ্যেই একেরপর এক হত্য হতে থাকেন বিজ্ঞানলেখক ব্লগাররা।

কেনো করা হয়েছে ৫৭ধারা?

৩.দেশপ্রেম আর বিজ্ঞান মনস্ক লেখকরা একদিকে যেমনি ধর্ম ব্যাবসা,ধর্মের নামে রাজনীতি,ধর্মের নানা অসংগতি নিয়ে টানা লিখে গেছেন,তেমনি লিখেছেন রাষ্ট্রের নানা অসংগতি নিয়েও। ধর্ম ব্যাবসায়ীদের আপত্তির জায়গাটা মূলত সেখানেই,আর সরকারি কাজের সমালোচনার জায়গা থেকে আপত্তি ছিলো সরকারের ও।

তবে ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি যুক্তিপূর্ণ আলোচনার জন্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্লগের ব্যাবহার দেশপ্রেমিক ব্লগাররা যেমনি ব্যাবহার করেছে তেমনি ব্যাবহার করেছে জঙ্গিবাদী,ইসলামপন্থী এ্যক্টিভিস্টরাও। এরা, জাতীয় বিভিন্ন ইস্যু,গনজাগরন আন্দোলনসহ দেশ বিরোধী নানা অবস্থানের প্রচার করতে থাকে ইন্টারনেট ব্যাবহার করে।এমনকি অনলাইনে সম্মেলন করে নিষিদ্ধ ঘোষিত বেশকিছু সংগঠন।

মূলত এরপরেই ৫৭ ধারা নামে নতুন একটি আঈন প্রনয়ন করে সরকার।


৫৭ ধারা কি আসলেই তার সঠিক কাজটি করতে পেরেছে?

৪. প্রশ্নটা এখন সর্বজনবিদিত। ৫৭ ধারা আঈনটি যেখানে ব্যাবহার হবার কথা ছিলো রাষ্ট্রবিরোধীদর বিরুদ্ধে সেখানে বারবারই ৫৭ধারা ব্যাবহার হয়েছে বাকস্বাধীনতা, মুক্তমনাদের বিরুদ্ধে। সরকার,সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে লেখালেখি করা লেখকদের বিরুদ্ধেই বেশী ব্যাবহার করা হয়েছে ৫৭ধারা।
কয়েকমাস আগে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইস্যুতে সরকারের সমালোচনার কারণে গ্রেফতার করা হয় ছাত্রমৈত্রি নেতা দীলিপ রায় কে,সরকারের সমালোচনার কারণে গ্রেফতার হয়েছেন,ছাত্রদল কর্মী,ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সহ অংসখ্য লেখক।

অথচ ফেসবুক,টুইটার,ইউটিউব ঘাটলেই পাওয়া যাবে আনসার-আল-ইসলাম সহ অসংখ্য পরিমান নিষিদ্ধ ঘোষিত সংঘটন এর নানা লেখা,ভিডিও আর ছবি।অথচ প্রশাসন এসব থেকে কাউকে গ্রেফতার বা ট্রেসও করতে পারেনি।জঙ্গিরা অনলাইনকে ব্যাবহার করে জঙ্গি তৎপড়তা,তথ্য প্রচার সহ নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে দেদারসে।সেখানে ৫৭ধারা কাজ করতে একেবারেই অক্ষমতান প্রমান দিয়েছে।

৫৭ ধারার বাতিল দাবি করেছেন অনেকেই। কেনো?

৫. আঈন প্রণয়ন হয় জনগনের জন্যে,জনগনের স্বার্থ রক্ষার খাতিরে।সেই আঈন যখন রক্ষক না হয়ে ভক্ষক হয়,জনগন যখন আঈন এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন সেই আঈনের প্রয়োজনীয়তা থাকেনা।৫৭ ধারার ব্যাবহারটা মূলত সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধেই ব্যাবহৃত হয়েছে প্রণয়নের পর থেকে।বাক স্বাধীনতা খর্বকারী ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে জনগনের অবস্থান নেবার কারনটা সেখানেই। মানুষের ভাব আদানপ্রদানের বড় মাধ্যম হলো তার কথা। এই কথা শুধু মুখের ভেতরেই থাকে না, মিডিয়া ও সামজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সব জাগায় স্থান করে নেয় বিভিন্ন উপায়। কথা বলতে না পারা বা না দেয়া বা ভয় চুপ করে থাকা কাপুরুষের কাজ। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে না পারলে নিজ দেশেও পরাধীন হয়ে যেতে হয়। এবং আসতে আসতে পুরো দেশটাই পরাধীনতার শৃঙ্খলে আটকে যায়, যেখান থেকে ফিরে আসতে পাড়ি দিতে হয় রক্তের সাগর।

সিদ্ধান্তটা আসলে আমাদেরকেই নিতে হবে,কি চাই আমরা?স্বাধীন দেশে বলার স্বাধীনতা,গনতান্ত্রিক দেশে জনগনের সরকারের ভূল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মাথা তোলাটা জনগনের অধিকার।সেই অধিকারকে খর্ব করা যেকোন নির্দেশনা,আঈনকে জনগনের স্বার্থে বাতিল করাটা একদিকে যেমনি সরকারের দায়িত্ব,তেমনি তা না করলে সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথের লড়াই অব্যাহত রাখাটাও জনগনের অধিকার।গন বাকস্বাধীনতা বিরোধী ৫৭ধারার অবিলম্বে বাতিল দাবি করছি।

মোঃ আরিফুল ইসলাম
সহ-সাধারন সম্পাদক
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন
ঢাকা জেলা সংসদ