প্রবীর সিকদার


আমার আজকের লেখাটি কার উদ্দেশ্যে লেখা, সেটা আমি জানি না, হয়তো বুঝিও না! লেখার বিষয়বস্তু সচরাচর ঘটে যাওয়া মামুলি দুটি ঘটনা। অবশ্য এই সব ঘটনা আমাদের গা সওয়া হয়ে যাওয়ায় তা অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। কিন্তু ওই রকম ঘটনার গুরুত্ব অসীম। কোনও সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে এমন ঘটনা শুধু বিরলই নয়, ভাবনারও অতীত। অথচ সেই সব গুরুতর ঘটনা আমরা বেমালুম হজম করে যাচ্ছি!

দুটি ঘটনা। দুই ঘটনার ব্যবধান মাত্র ১৩ দিন। একটি ফরিদপুর শহরের, অপরটি যশোর শহরের। দুই জেলার থানার নাম একই, কোতোয়ালি।

গত ২৮ মে ফরিদপুরের আদালতে হাজিরা দিতে এসেছিলেন ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সরকারি রাজেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ সংসদের সাবেক জিএস তুখোড় ছাত্রনেতা এডভোকেট সত্যজিৎ মুখার্জি। বহুল বিতর্কিত ও সাজানো ২৪ মামলায় দীর্ঘদিন ফরিদপুর জেলা কারাগারেই আটক ছিলেন তিনি। গত ২১ মে তিনি জামিনে মুক্তি পান। মুক্তির পর আদালতে সত্যজিতের হাজিরার দিন ছিল ২৮মে। সত্যজিতের অনুগত ছাত্রলীগের কর্মীরা আদালতে তাকে দেখতে এসেছেন; এতে কোনো অস্বাভাবিকত্ব ছিল না সেদিন। অস্বাভাবিকত্ব ছিল অন্য ঘটনায়, যেখানে পুলিশের ছত্রছায়ায় থাকা একদল দুর্বৃত্ত ফরিদপুরের আদালত চত্বরে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সেদিন দুর্বৃত্তরা সত্যজিতকে অপহরণেরও অপচেষ্টা করেছিল। অবশ্য আদালত চত্বরের সেই ভয়াবহ আতঙ্কজনক পরিস্থিতি নিয়ে কোনো উদ্বেগ ছিল না বিচারক, আইনজীবী ও প্রশাসন-পুলিশের কর্মকর্তাদের। জেলার দায়িত্বে থাকা দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে টেলিফোনে জানানোর পরেও কেউ সত্যজিৎ ও তার কর্মীদের পাশে দাঁড়ায়নি। সত্যজিতের অনুগত ছাত্রলীগের আতঙ্কিত কর্মীরা যখন দেখা সাক্ষাত সেরে আদালত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ওই দুর্বৃত্ত চক্র তাদের ওপর হামলা করে এবং নির্মমভাবে মারপিট করে ৭ জনকেপুলিশের হাতে তুলে দেয়। পরে অবশ্য কোতোয়ালি থানা পুলিশের এসআই মো. মনির হোসেনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ উদ্ধারের নামে সত্যজিতকে ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায় এবং নানা নাটক শেষে আরও একাধিক সাজানো মামলায় সত্যজিতকে আটক দেখানো হয়। নতুন মামলাগুলোতে সত্যজিৎ ছাড়াও আসামী করা হয় তাকে দেখতে আসা ৭ ছাত্রলীগ কর্মীকে, দুর্বৃত্ত চক্র যাদেরকে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল। ঘটনা এই পর্যন্ত হলেও চলতো! কিন্তু পরেরদিন অর্থাৎ ২৯ মে ঘটনার নানা ডালপালা গজিয়ে যাওয়ার পর সত্যজিৎ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের যখন থানা থেকে আদালতে নেওয়া হয় তখন জানা গেল, আটক সত্যজিৎ ও ছাত্রলীগ কর্মীদেরকে নানা মামলায় আসামী করা ছাড়াও ৪ ছাত্রলীগ কর্মীকে সুনির্দিষ্টভাবে একটি মাদক মামলায় আসামী করা হয়েছে। আমি তো প্রথমে মাদক মামলার কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক! পরে বিস্তারিত শুনে আমার বিস্ময়ের মাত্রা বাড়তেই থাকলো।

ছাত্রলীগের যে ৪ কর্মীকে মাদক মামলায় আসামী করা হয়েছে তারা হলেন, সুমন সাহা, বোরহানুস সুলতান ওরফে সোহেল, মো. মামুন খান ও রানা খান। মামলার বিবরণে জানা যায়, গত ২৮ মে রাত পৌনে ১০ টার দিকে ফরিদপুর শহরের আলীপুর গোরস্থানের পেছনের পাকা রাস্তা থেকে ১০০০ পিস ইয়াবাসহ ওদেরকে আটক করেছেন সেই করিৎকর্মা এসআই মো. মনির হোসেন। মামলার বাদীও তিনিই। এজাহারে তিনি বলেছেন, ইয়াবা বিক্রির সময় তাদেরকে হাতেনাতে আটক করা হয়। অথচ ওই দিন হাজারো মানুষ চোখে দেখেছেন, দুর্বৃত্তরা দুপুরের পর পরই আদালত চত্বরে ওই ছাত্রলীগ কর্মীদের পিটিয়ে পুলিশে দেওয়ার ঘটনা। আর এসআই মনির অবলীলায় তাদেরকে রাতে আলীপুর গোরস্থানের পেছনের পাকা রাস্তা থেকে আটকের নাটক লিখে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দিলেন! প্রভাবশালীদের স্বার্থ রক্ষা করতে পুলিশ এতোটা নির্লজ্জ হতে পারে,এই ঘটনা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ না করলে সেটা অনেকটাই আমার বোধগম্যের বাইরে থাকতো।

ফরিদপুরের ছাত্রলীগ কর্মীদের এমন জাল-জুয়াচুরির ইয়াবা মামলায় ফাঁসানো নিয়ে আমি যখন চূড়ান্ত হতাশায় নিমজ্জিত, ঠিক তখনই আর একটা খবর আমাকে আশার ঝলক দেখিয়ে যায়। ঘটনাটি গত ১০ জুন রাত পৌনে ১০টায় ঘটেছে যশোর শহরের সোনালী ব্যাংক কর্পোরেট শাখার সামনে। যশোরের কোতোয়ালি থানার এসআই মাহবুবুর রহমান সেখানে তল্লাশির নামে এক মোটরসাইকেলের দুই তরুণ আরোহী শৈশব ও সুব্রতকে থামান। তল্লাশিকালে কিছু না পাওয়া গেলে ওই এসআই মাহবুব অতি দ্রুততার সাথে তার হাতে থাকা এক পোটলা গাঁজা সুব্রতের পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তারা দুই বন্ধু এই ঘটনার প্রতিবাদ করে হইচই করলে এলাকার লোকজন সেখানে জড়ো হন। শৈশব তার মোবাইলফোনে স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে ওই এসআই ফোন কেড়ে নিয়ে আছড়ে ভেঙে ফেলেন। লোকজন আরও জড়ো হলে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তারা পুলিশ কর্মকর্তাকে ঘেরাও করে মারমুখী হয়ে ওঠেন। পরে খবর পেয়ে কোতোয়ালি থানার ওসি মো. শামসুদ্দোহা ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে ওসি সাহেব শৈশবের ভেঙে ফেলা মোবাইলফোন বাবদ তিন হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ও অপকর্মে জড়িত এস আই মাহবুবের শাস্তির আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। পরে এই ঘটনা জেনে যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান দ্রুততার সাথে এক আদেশে অভিযুক্ত এসআই মাহবুবকে কোতোয়ালি থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করেন।

ফরিদপুরের ঘটনাটির সাথে যশোরের ঘটনার বেশ মিল। যদিও দুই ঘটনার ফল দুই রকমের শুধু নয়, পরস্পর উল্টোও। স্বস্তি-অস্বস্তির দোলায় আমি শুধুই ভাবছি, যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান পুলিশের ভাবমূর্তি নস্যাতকারী এসআই মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা শুরু করতে পেরেছেন; কিন্তু ফরিদপুরের পুলিশ সুপার সুভাষ সাহা কি পারবেন ছাত্রলীগ কর্মীদের ইয়াবা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া এসআই মো. মনির হোসেন ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে আমাকে, আমাদেরকে আস্থার সংকট উত্তরণে সাহায্য করতে? এখন শুধুই আমার দেখার পালা, ফরিপুরের পুলিশ সুপার সুভাষ সাহা কি করেন কিংবা কি করতে পারেন! তবে আমার গভীর আস্থা রয়েছে পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক মহোদয়ের ওপর। উনি এই ঘটনা জানতে পারলে ছাত্রলীগ কর্মীদের ইয়াবা মামলায় ফাঁসানোর ঘটনায় জড়িত ফরিদপুরের পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ রেহাই পাবেন না।