শরীয়তপুর প্রতিনিধি : খুলনা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে শরীয়তপুর অংশের ৪০ কিলোমিটার সড়কের ৩৫ কিলোমিটারই বড় বড় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়ে যান চলাচলে সম্পূর্ন অযোগ্য হয়ে পরেছে। সড়কটি এখন রীতিমত একটি মৃত্যুফাঁদে পরিনত হয়েছে। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা। বারবার মেরামত করেও ব্যবহার উপযোগী করা যাচ্ছেনা সড়কটি। ১ ঘন্টার রাস্তা পাড়ি দিতে যাত্রীদের ব্যয় করতে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা। সড়ক সংস্কারের নামে লোপাট হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। সড়ক বিভাগের প্রকৌলীদের সাথে হাত মিলিয়ে ঠিকাদারেরা গত তিন বছরে অন্তত ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বুধবার একটি সংস্কার কাজে অনিয়ম পাওয়ায় কাজটি বন্ধ করে দিয়েছেন শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক।

ঢাকা শহরের ওপর থেকে যানজট নিরসনের লক্ষ্যে খূলনা, বরিশাল বিভাগ ও বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের সাথে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের সাথে এবং মংলা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যে সড়ক পথে দুরত্ব কমাতে ২০০১ সালে চাঁদপুর-শরীয়তপুর ফেরী সার্ভিস চালু শুরু করে খুলে দেয়া হয় খুলনা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এতে স্থান ভেদে সড়ক পথে দুরত্ব হ্রাস পায় ১২০ কিলোমিটার থেকে ২৫০ কিলোমিটার। আর সময় বাচেঁ ২ ঘন্টা থেকে ৬ ঘন্টা। ফলে দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্বাঞ্চল থেকে দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে সড়ক যোগাযোগে সৃষ্টি হয় এক যুগান্তকারি পরিবর্তন। এই মহা সড়কটির কানেক্টিং রোড হিসেবে ব্যববহার করা হয় শরীয়তপুর জেলাকে। খোঁয়াজপুর থেকে আলুর বাজার ফেরীঘাট পর্যন্ত শরীয়তপুর জেলার অভ্যন্তরে ৪০ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে এই মহা সড়কে। যা বর্তমানে প্রায় পুরোটাই চলাচলের অযোগ্য। শুধু এই সড়কটিই নয় শরীয়তপুর সওজ এর আওতায় পরিচালিত প্রতিটি সড়কের উন্নয়ন-মেরামত কাজেই হয় সীহীন দূর্নীতি। সড়ক বিভাগে পেশাগত দায়িত্ব পালনার্থে কোন তথ্য চাইতে গেলে গণমাধ্যম কর্মীদের কখনোই তথ্য প্রদান করেননা কর্মকর্তারা।

সড়কে থাকা বড় বড় গর্তে প্রায়ই আটকে যাচ্ছে পণ্য ও যাত্রীবাহী যনবাহন। আবার অন্য গাড়ী পাশ কাটাতে গিয়ে উল্টে খাদে পরছে অনেক যানবাহন। গত দশ দিনে আঙ্গারিয়া, মনোহর বাজার, রুদ্রকর, মাকসাহার, আমিন বাজার, লাঙ্গলভাঙ্গা, বুড়িহাট, পাপরাইল, মির্জাপুর, ভেদরগঞ্জ উপজেলার মোড়, পশ্চিম গৈড্যা মাস্টারবাড়ির মোড়, পুটিয়া তালুকদার বাড়ি মোড়, নারায়নপুর বাজার মোড়, বাওইকান্দি, কাশিম বাজার ও বালার বাজরসহ সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে মংলা-চট্টগ্রাম বন্দরে যাতায়াতকারি ১৫টি পন্যবাহি ট্রাক খাদে আটকে ফেঁসে যায়। ৮টি ট্রাক উল্টে যায়, ২টি ট্রাক খাল ও পুকুরে পরে যায় এবং খুলনা-চট্টগ্রাম ও বরিশান-ফেনী রুটের অন্তত ২৮টি যাত্রীবাহি বাস বিকল হয়ে হাজার হাজার যাত্রী ভোগান্তিতে পরে। এসব এখন নিয়মিত চিত্র খুলনা-চট্রগ্রাম আঞ্চলিক সড়কের শরীয়তপুর অংশের আঙ্গারিয়া থেকে আলুরবজার নরসিংহপুর ফেরীঘাট পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার রাস্তার। যেখানে এক ফুট জায়গাও নিরাপদে চলাচলের কোন সুযোগ নেই।

২০১৪-১৫ অর্থ বছরে প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সিলকোট কার্পেটিং এর মাধ্যমে সড়কটি মেরামত করেছিল শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগ। বছর না ঘুরতেই সড়ক জুরে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে চলাচলের অনুপোযোগি হয়ে পরে সড়কটি। আবার ২০১৬ সালের জুন মাসে প্রায় পৌনে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটি নামমাত্র মেরামত করানো হয়। মেরামতের পর ৩ মাস না পেরুতেই সড়ক জুরে খানাখন্দ সৃষ্টি হওয়ায় আবারও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পরেছে সড়কটি। সড়ক চালু রাখার নামে, লোক দেখানো কাজ হিসেবে কোটি টাকা লুটপাটের উদ্দেশ্যে বর্তমানে আবার প্রায় ৪ কোটি ব্যয়ে পাকা পিচ ঢালা সড়কে বসানো হচ্ছে ইটের সোলিং ও সামান্য সিলকোট কার্পেটিং রিপেয়ারিং।

বুধবার শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হোসাইন খান উল্লেখিত মহা সড়কের একটি সীলকোট কার্পেটিং রিপেয়ারিং কাজের পরিদর্শণ করতে গিয়ে দেখেন, তনিমা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সংস্কার কাজে ব্যবহার করছে সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ সামগ্রী। সেখানে সড়ক বিভাগের কোন কর্মকর্তাকে খুঁজে পাননি জেলা প্রশাসক। একজন চতুর্থ শ্রেনির কর্মচারি দিয়ে চালানো হচ্ছে গোট উন্নয়ন কাজ। এ কাজে যে পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে তাকে বলা হয়ে থাকে উঊঅঞঐ ঝঞঙঘঊ বা মৃত পাথর। এ ধরনের পাথর সরকারি কোন কাজে ব্যবহার উপযোগি নয় মর্মে গত প্রায় ৫ বছর আগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। শুধু ডেথ ষ্টোনই নয় সেখানে যে ধরনের বিটুমিনাস বা পীচ ব্যবহার করা হচ্ছে তাও সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ। দেখা গেছে বাংলা পীচের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে ইরান থেকে আমদানিকৃত নিন্ম মানের পীচ। ফলে জেলা প্রশাসক কাজটি বন্ধ করে দিয়ে সরকারি প্রাক্কলন অনুযায়ী সকল উপকরণ ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করেন।

অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে, নিয়ম কানুন ঠিক রেখে শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও যুগের পর যুগ অসাধূ কর্মকর্তাদের পছন্দের কিছু ঠিকাদারের ভাগ্যেই জুটছে ৯০ শতাংশ কাজ। এখানে কর্মকর্তা বদল হলেও লুটপাটতন্ত্রে কোন পরিবর্তন হয়না। তনিমা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেই ঘুরে ফিরে দেখা যায় অধিকাংশ কাজ হাসিল করতে। সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানের সত্বাধিকারি জনৈক সেলিম মিয়া গত কয়েক বছরে একটি নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও মালিক হয়েছেন কয়েক কোটি টাকার।

এই সড়কে যানবাহন চালাতে গিয়ে অসহনীয় বিড়ম্বনায় পরতে হয় চালকদের। আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবহন মালিকরা। বিভিন্ন রুটে চলাচলকারি যাত্রীদের ও পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন ভোগান্তি। মাত্র কয়দিন পরেও ঈদুল ফিতর। ঈদ উপলেক্ষ্যে এই সড়কে হাজার হাজার যাত্রীদের যাতায়াতের কথা। যাত্রী, চালক ও পরিবহন মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অনতিবিলম্বে সরকার এই সড়কের উন্নয়নের ব্যবস্থা না করলে এই সড়কটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবেন তারা।

সড়ক মেরামতের কাজে নিন্মমানের ও সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ নির্মান সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তনিমা এন্টারপ্রাইজ এর মালিক সেলিম মিয়া বলেন, আমি কি কাজ করছি বা কি কাজে কোন ধরনের মালামাল ব্যবহার করছি এ বিষয়ে সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে জিজ্ঞেস করুন। আমি অফিসের নির্দেশ ও ডিজাইন অনুযায়ীই কাজ করছি।

সড়ক উন্নয়ন কাজে দূর্নীতি ও নিন্ম মানের উপকরণ ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ দাশগুপ্ত ক্যামেরার সামনে কোন কথা না বলে গোপালগঞ্জে মিটিং থাকার অযুহাতে অফিস ত্যাগ করেন। তবে তিনি সড়কটি চলাচলে অনুপযোগি হওয়ার কারন হিসেবে অতিরিক্ত পন্য বোঝাই যান চলাচলকেই দায়ি করেছেন। আর এই সমস্যা সমাধানে একটি ডিপিপি প্রনয়নের মাধ্যমে পরামর্শক নিয়োগ করে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন।

শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, এই সড়কের সদর উপজেলার মনোহর বাজার গো হাটের কাছে একটি কার্পেটিং কাজে নিন্ম মানের উপকরণ ব্যবহার করতে দেখে আমি তাৎক্ষনিকভাবে কাজ বন্ধ করে দিয়ে প্রাক্কলন অনুযায়ী ভালো উপকরণ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। এ আদেশ অমান্য করলে ঠিকাদার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনে সুপারিশ করবো।

এলাকার সচেতন লোকেরা মনে করেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সড়ক বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসের কারনেই প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও সড়ক উন্নয়নে কোন ফল পাওয়া যাচ্ছেনা। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ২টি বন্দর ও চারটি বিভাগের সাথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনকারী মহাসড়কটির মাত্র ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে যানবাহন চলচলের উপযোগী করা হলে দেশের আমদানী রপ্তানীতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে অভিমত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের। আসন্ন ঈদে এই পথে যাতায়াতকারি হাজার হাজার যাত্রীর দূর্ভোগ কমাতে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহনের কথাও দাবি জানিয়েছেন তারা।

(কেএনআই/এএস/জুন ১৫, ২০১৭)