ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম


 

আজ রবিবার বিশ্ব বাবা দিবস। এনসাইক্লোপেডিয়া থেকে জানা গেছে, জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বের প্রায় ৭৪টি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়।বাবার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, জানানোর জন্যই এই দিবস। তবে বাবা কি শুধুই একটি বিশেষ দিনের জন্য! বাবা আর সন্তানের সম্পর্ককে কোনো দিবস দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না।

মানুষকে মহান আল্লাহ অফুরন্ত নিয়ামত দান করেছেন। সেই অসাধারণ সুন্দর নিয়ামতের একটি সন্তানের জন্য তার মা-বাবা। বাবা, সন্তানের মাথার ওপর যার স্নেহচ্ছায়া বটবৃক্ষের মতো, সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় তাকে, আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো বাবা। বাবার তুলনা বাবাই। যার কল্যাণে এই পৃথিবীর রূপ, রঙ ও আলোর দর্শন। বাবা শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন।বাবাকেই আদর্শ মনে করে সন্তানরা। বাবা সন্তানকে শেখান, কীভাবে মাথা উঁচু করে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হয়।আজ বাবা আমাদের মাঝে নেই, তিনি ১১ নভেম্বর ২০১৬, শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি আর কখনও আমাদের মাঝে আসবেন না, চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

‘আমার বাবা’—এই দুটি শব্দের মধ্যে নিহিত আছে বাবার জন্য আমার বলা না-বলা যত আবেগ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, গর্ব; তাঁকে হারানোর কষ্ট আর অশ্রু।

জীবন প্রবহমান এক গতিধারা। কখনো তরঙ্গময়, কখনো নিস্তরঙ্গ। ক্ষণিকের যাত্রা হয়তো। আর কিছু না। বেঁচে থাকাই যেন বিস্ময়, তবে ভালো কাজের মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ করাটাই মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। যাতে মৃত্যুর পরও মানুষ বেঁচে থাকার সময়ে যে কাজ করা হয় তা নিয়ে আলোচনায় মেতে থাকে। জীবন যাতে মানবকল্যাণে, দেশের কল্যাণে নিবেদিত থাকে।

আব্বা আমাদের কাউকে কিছু না বলে, কাউকে কিছু করার কোন সুযোগ না দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। আর কখনও আব্বার সাথে দেখা হবে না, কথা হবে না এটি আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়। খবরটা শোনার পরও বিশ্বাস করিনি, ভেবেছি কোথাও কোন ভুল হচ্ছে।

জীবন বহমান। সকল হারানো কিংবা শোক-তাপের ঊর্ধেও জীবন স্বীয় গতিতে চলবে। এটাই চিরন্তন সত্য। স্মৃতি শুধুই স্মৃতি। কিছু স্মৃতি বড়ই বেদনাদায়ক। কিন্তু স্মৃতিকে যেমন ভূলে থাকা যায় না তেমনি অস্বীকারও করা যায় না।

বাবাকে আমি ‘আব্বা’ ডাকতাম, আমার কাছে মনে হতো এই সম্বোধনটাই বেশি কোমল এবং বেশি কাছের। প্রতিটি সন্তানের বুক জুড়ে থাকে বাবার প্রতি চির অম্লান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। এই ভালোবাসা জগতের সকল কিছুর তুলনার ঊর্ধে। আর সেই ভালোবাসা যদি সঠিক সময়ে সঠিক প্রয়োগ না হয়, তাহলে জীবনের প্রতিটি পদে, প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে নিজের কাছে-ই অপরাধী করে তুলতে পারে। আমি জানি, আমি আমার বাবাকে কতোটা ভালোবাসি। কিন্তু আজ আমার সেই ভালোবাসা আমি কাকে প্রর্দশন করবো? কাকে আমি সেই প্রিয় ‘আব্বা’ বলে ডাকবো? আমার ভাগ্যবিড়ম্বিত এই আক্ষেপ অন্তরের। এই জ্বালা কি কোনদিন নিভবে?

বাবার কথা মনে পড়ে কেন? আজ বাবা নেই। তুমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমাদের ছেড়ে তুমি চলে গেছে দূরে , বহু দূরে। আমাদের শোক সাগরে ভাসিয়ে তুমি চলে গেছো না ফেরার দেশে। পৃথিবীর কোন শক্তি তোমাকে আর আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিতে পারবে না জানি।

কোথায় যেন কী নেই। আকাশের দিকে তাকালে আকাশে সুুরুজ নেই। রাতের সিতারা নেই। চাঁদ নেই। জোছনা নেই। দিকে দিকে খাঁ খাঁ শূন্যতা ভর করেছে। বাবার সাহচার্য-সহযোগিতার কাঙাল হয়ে উঠছি দিন দিন।

আহ! আজ দিন চলে গেছে। আমি বাবাহীন অসহায়। আমার পথের চার দিক তিমিরে ঘেরা। আমাকে আপন করে আর কেউ ভালোবাসে না। বাবার মতো মমত্ব নিয়ে কেউ তো আর এলো না এ জীবনে। কেউ আর বাবার মতো নিঃস্বার্থ ভালোবাসে না। সবার ভালোবাসার ভণিতার মাঝে স্বার্থ কাজ করে। সবাই ভালোবাসার অভিনয় করে বিনিময়ে কিছু নিতে চায়। কিন্তু বাবা তোমরা তো কিছু নিতে চাও না, শুধু দিতে চাও।বাবা আমার খুব আবেগি ছিলেন। আমাকে খুব শাসন করতেন। খুব আদর করতেন।

বাবা নেই! বাবা! না, এ হতে পারে না! সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ এভাবে মারা যেতে পারে না। কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এই মাত্র আমাদের সাথে কথা বললেন। আমাদের সাথে খাবার খেলেন। তিনি কিভাবে চলে যাবেন?

আসলে কেউ জানে না কার ডাক কখন আসে। একটু আগের হাসিখুশি মানুষটি হঠাৎ মহান রবের ডাকে অনন্ত জীবনের পথে যাত্রা করলেন। আমরাও যেকোনো একদিন এভাবেই রবের ডাকে সারা দেবো। চলে যাবো চিরতরে।

পৃথিবীতে এমন কোনো ভাষা নেই, এমন কোনো সাহিত্য নেই যা দিয়ে আমার মনের এ ক্ষতকে প্রকাশ করতে পারব। এমন কোনো সান্ত্বনার বাণী নেই, যা শুনিয়ে আমার বুকের মাঝে পাথরচাপা কষ্টগুলোকে কমানো যাবে। আমার বাবা নেই। আমার বটবৃক্ষ নেই। যে আমার জন্ম থেকে তার শীতল ছাড়া দিয়ে বড় করেছে। আমি সে মহীরুহ ছাড়া শূন্য হলাম। এখন গ্রীষ্মের তাপদাহে আমার গা পুড়ে ছারখার হবে। কেউ আর বটবৃক্ষের ছায়া নিয়ে আমার পাশে দাঁড়াবে না। কেউ না। আমি সূর্যের তেজে মোমের মতো গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যাবো ধীরে ধীরে।

ফুফু সান্ত্বনা দিলেন : বাবা কারো চিরদিন বেঁচে থাকে না। আমরাও একদিন চলে যাবো। আমি বুঝিনি তার এহেন প্রস্থান আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আঘাত। সবচেয়ে বড় বেদনা। বড় ক্ষত। বড় কষ্ট।

আসলে যার বাবা আছে সে বোঝে না বাবা কী! যার নেই সেই বোঝে! কিন্তু সময়মতো না বুঝলে সারা জীবন কাঁদতে হয়। কেউ কাছে এসে বাবার মতো সোহাগ দেখায় না। কেউ আগলে রাখে না। কেউ ভাবে না বাবার মতো। বাবা তো বাবাই। পৃথিবীর কিছু দিয়ে কি তার তুলনা চলে? সন্তানের বড় হওয়ায় যাবতীয় আয়োজন। মানুষ হওয়ার যাবতীয় প্রোগ্রাম সব তো বাবাই করেন। বাবা আর ফিরবে না। আজকে যারা বেঁচে আছি একদিন সবাই চলে যাবো, কেউ ফিরব না। তবে যত দিন আছি, এ ধরাধামে তত দিন তো বাবা হারানোর ব্যথা বয়ে বেড়াতে হবে।

আপনাদের মধ্যে যাদের বাবা এ পৃথিবী থেকে বিদয় নিয়েছেন তারা কি কেউ পিতৃহীনতার ব্যথা থেকে মুক্তিলাভ করতে পেরেছন? কখনো কি পারবেন? কারও বাবা-মা চিরজীবন বেঁচে থাকেন না। মানুষের জন্মই হয় একদিন মৃত্যুর স্বাদ লাভ করার জন্য। সবাই মরণশীল। তবুও এত কষ্ট হয় কেন চলে যাওয়ায়? সবার বাবা সবার কাছেই অতি প্রিয় ও মূল্যবান। আমরা সবাই কিন্তু দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্যায়ন করি না, ঠিক তেমনি বাবা জীবিত থাকতে বুঝতে পারি না যে কী ছায়ার নিচে নিজেদেরকে রাখছি। বটগাছের ছায়া, রোদ-বৃষ্টিতে আশ্রয়ের স্থান। বিপদ-আপদে, রোগ-শোকে, দুশ্চিন্তা-কান্নায় যার কাছে নির্দ্বিধায় যাওয়া যায়। যে স্বার্থহীনভাবে বুকে আগলে ধরে তার যতটুকু জ্ঞান, প্রজ্ঞা আছে তা দিয়ে রক্ষাকবচ হিসেবে, ঢাল হয়ে রক্ষা করে, সে হলো বাবা।

তুমি আমাদের সকলকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গছেো, তুমি বেঁচে থাকতে তোমার গুরুত্ত আমরা বুঝি নাই, আজ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি তোমার অনুস্থতি, তোমার চলে যাওয়া আমাদের জীবনে বিশেষ করে আমার জীবনে অপুরনীয় ক্ষতি।

আমার বাবা একজন ভালো ও নীতি আদর্শবান ছিলেন। তিনি ছিলেন বললে ভুল হবে, তিনি এখনো আমাদের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে থাকেন, এটা আমার অনুভব, আমার বিশ্বাস। আমার জন্ম ও শিক্ষাজীবনের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত আমার চাকরী অঙ্গনে প্রবেশের প্রথম দিন থেকে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার ছত্রছায়ায় ছিলাম। চলার পথে, কি পারিবারিক জীবন ক্ষেত্রে, কি পেশা/চাকরী জীবন ক্ষেত্রে, কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক ঝড়ঝাপটার সম্মুখীন হয়েছি। বাবা আমার, তার মেধা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাকে তার প্রশস্তবুকে আগলে রেখেছিলেন। এখন কোনো বিপদে দিশাহারা হয়ে পড়ি। অভিভাবকহীনতার কষ্টে ভুগি। কারও পরামর্শ চাইলে শুনতে হয়- ‘দেখ, তুমি অনেক দায়িত্বশীল পর্যায়ে আছ, আমাদের চেয়ে ভালো বুঝ- যা ভালো মনে কর, তাই কর।’ এখন কেউ বলার নেই- থাম, আমি দেখছি, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ, সব ঠিক হয়ে যাবে, নিজে ভালো তো জগৎ ভালো- নিজে ভালো থাকলে, ঠিক থাকলে, সবই ভালো থাকে বা হয়। মাথায় স্নেহের হাত বুলানোর কেউ নেই। বাবা থাকতে মনে হতো না আমি বড় হয়েছি, মনে হতো এখনো ছোট আছি। এখন মনে হয় বয়স হয়েছে, নিজেরই বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাবা হারানোর ব্যথা বা বাবাহীন জীবনের কষ্ট ভয়ানক। যে বাবা হারায়নি সে এই ব্যথা বুঝবে না।

আদর্শবান বাবা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালনে একটুও শিথিলতা প্রদর্শন করেননি। পাঁচ বছর বয়স থেকে আমাকে নামাজে অভ্যস- করেন। এর পর থেকে কোনো দিন নামাজ ছাড়া তো দূরের কথা, জামাতে নামাজ না পড়লে আব্বার কঠোর বকুনি শুনতে হতো।

মানুষ হিসেবে যেসব মৌলিক গুণ থাকা উচিত, তার সব কিছুই আব্বার কাছ থেকে শিখেছি। সর্বক্ষেত্রে মিথ্যা কথা থেকে বিরত থাকা, ওয়াদা রক্ষা করা, সময় অনুযায়ী চলা, সময়ের অপচয় না করা, মানুষের সাথে সব সময় ভালো আচরণ করা ইত্যাদি অনেক বিষয়ে প্রায়ই তিনি আমাদের কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাতেন। এগুলোর কোনো কিছুতে ভুল হলে খুবই রাগ করতেন।

আমার বাবা একদম সাদামাটা ছিলেন তার আধুনিকতা সম্বন্ধে ধারণা কম ছিল। বাবার জন্য নতুন কিছু কিনে আনলে প্রথমেই বলতেন ‘অনেক আছেতো আবার কেন? কেন পয়সা নষ্ট করলে, শুধু শুধু খরচ করলে, তারপরেই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত থাকতাম, কত নিয়েছে এত টাকা দাম না, আমি চালাকি করে আগে থেকেই দাম লেখা কাগজটা খুলে ফেলতাম। দামের কথা এড়িয়ে যেতাম। আমার বাবা কখনোই দামি কোন কিছু পরতেন না।

আমার বাবা অনেক সময় আমাকে বলতেন তুমি খুব আবেগপ্রবণ, হুজুকে চল, বাস্তববাদী না, ঠিক সময় ঠিক কাজ করতে পারি না, যার কারণে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়। তাই মাঝে মাঝে বকা শুনতে হতো। আবার আমার অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য প্রশংসা করতেন। তবে আমি যা কিছু করতাম আব্বাকে না জানিয়ে করতাম না। আমার কাছে তিনি অনেক কথা বলতেন, পুরনো দিনের স্মৃতিচারণা করতেন, মানুষকে খুব ভালোবাসতেন। রাজনীতির কথা গল্প করতেন। কারও বিরুদ্ধে কিছু বলা একদমই পছন্দ করতেন না। তিনি ছোট বড় সবাইকে সম্মান করতেন, সদা হাস্যজ্বল মানুষের বিপদে আপাদে তাদের আন্তরিকভাবে পাশে থাকতেন এবং কীভাবে মানুষকে আপন করে নিতে হয় তা তিনি জানতেন। প্রিয় মানুষ বা কাছের মানুষ পেলে বুকে জড়িয়ে ধরা, হাতটা ধরে নিয়ে নিজের হাতের মুঠোয় রাখা, আদর করা তার স্ব-ভাব সুলভ একটি আচরন।কারও কোনো ভালো খবর জানতে পেলে খুশি হয়ে তা আমাদেরও জানাতেন। পরিচিত কারও মৃত্যুর সংবাদ পেলে যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন, শরীর সুস্থ না থাকলেও জানাজায় শরিক হতেন।

আমার বাবা আলহাজ্জ্ব কে.এম আবদুল করিম ( রাহিমাহুল্লাহ ) ছিলেন ঝালকাঠী জেলার রাজাপুরস্থ সাতুরিয়া হামিদিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। আমার বই পড়ার অভ্যেস বাবাকে দেখেই। প্রচুর ইংরেজি শব্দ জানতেন, ছোটোবেলায় আমাদের শেখাতেন। তার শিক্ষকতার আদর্শই তার সমগ্র জীবনাচরণের অঙ্কুর ও শেকড়কে ধারণ করেছিল। এদিকে তার সকল মানবিক গুণাবলি, কর্তব্য-পরায়ণতা, দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা, সাহসিকতা ও ন্যায়ের পাশে দাঁড়ানোর সমুদয় সত্যনিষ্ঠায় যর্থাথই হয়ে উঠেছিল তার পরিচয় I বাবা যা সঠিক মনে করেছেন, তা দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করেছেন। কখনো তিনি আশা ছাড়েননি। তিনি বিশ্বাস করেছেন, আমাদের মধ্যে যে অপূর্ণতা, অসত্য ও অমানবিকতা রয়েছে, তা পেরিয়ে আমরা একদিন সত্যিই সুন্দর ও সত্যের ভোর দেখব।

আমার বাবা এলাকায় গড়ে তুলেছেন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে সাতুরিয়া ইঞ্জিনিয়ার এ,কে,এম রেজাউল করিম কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজ, আমড়াঝুড়ি জামিয়া ইসলামীয়া বহুমুখী দাখিল মাদ্রাসা, কে,এম, আ: করিম জামিয়া ইসলামীয়া এতিমখানা অন্যতম।

এছাড়াও শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক রিসার্চ ইনস্টিটিউট, মাওলানা আ: রহীম, (র:) স্মৃতি পাঠাগার, মোস্তফা হায়দার একাডেমী, পূর্ব আমড়াঝুড়ি বায়তুল মামুর জামে মসজিদ, সাতুরিয়া খানবাড়ী জামে মসজিদ, উত্তর তারাবুনিয়া মোল্লাবাড়ী জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠির মানোন্নয়নে ভূমীকা রেখেছেন। সম্প্রতি কাউখালি শহরে দৃষ্টি নন্দন ফোয়ারা ও বিশ্রামাগার স্থাপিত হয়েছে মোসলেম আলী খান ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগিতায়। ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলায় তিনি বাংলা অনুবাদ কোরআন শরীফ বিতরন করেন।

সেবামূলক কাজ পরিচালনার জন্য মোসলেম আলী খান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে গরীব ছাত্র-ছাত্রী ও মসজিদের ইমামদের মধ্যে আর্থিক সহয়তা প্রদান করেছেন। রাজাপুর শহরে আর্সেনিক মুক্ত বিশুদ্ধ পানির জন্য তিনি সম্প্রতি ইসরাব নামক একটি এনজিওকে ঋন দিয়েছেন।

বাবা কতো লোকের উপকার করেছেন, কতো স্টুডেন্টকে ফ্রিতে পড়িয়েছেন, পার্থিব সম্পদের চাইতে মনের ঐশ্বর্য বাড়াতে চেষ্টা করেছেন; কিন্তু কখনোই বিন্দুমাত্রও অহংকার দেখাতে দেখিনি। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায় আমার বাবা একজন আজন্ম সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। সভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি ধর্মভীরু ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। কখনোই তার মধ্যে কোন গোঁড়ামি দেখিনি।

ভয়াবহ ঘুর্নঝড় সিডরের পরে মোসলেম আলী খান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের ত্রান তৎপরতা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। এ সময় তার প্রতিষ্ঠিত মোসলেম আলী খান ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কাউখালি, ভান্ডারিয়া, ঝালকাঠি সদর, রাজাপুর, কাঠালিয়া, পিরোজপুর, পটুয়াখালির কলাপড়া, বরগুনার পাথরঘাটা এবং বাকেরগঞ্জ থানায় ৩ হাজার ৬শ ৭০ জন দূর্গত মানুষের মধ্যে শাড়ি-লুঙ্গি, শীতের কাপড়, শুকনো খাবার, হাড়ি-পাতিল,থালাবাসন, খাবার স্যালাইন, ঔষধ ও নগদ অর্থ বিতরন করেন। কুরবানীতে তিনি কাউখালি ও ভান্ডারিয়ার প্রতিটি ইউনিয়নে এবং রাজাপুর ও ঝালকাঠিতে পশু কোরবানী দিয়ে সিডর আক্রান্ত ২ হাজার দুস্থ মানুষের মধ্যে গোশত বিতরন করেছেন। সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি আর্থিক সাহায্য করেছেন। যার মধ্যে কাউখালির কেউন্দা স্কুল ও সাতুরিয়া রহমIতয়া দাখিল মাদ্রাসা অন্যতম। এসব এলাকায় সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কিছু মসজিদেও তিনি আর্থিক সহয়তা প্রদান করেন।

আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওয়া আমার বাবা। আমার বাবা সারাজীবন মানুষের উপকার করেছেন। তিনি নিজেকে নিয়ে যতটুকু ভাবতেন তার চেয়ে বেশি ভাবতেন দেশ এবং সমাজকে নিয়ে। তার জীবনের আদর্শ ছিলো মানুষের উপকার করা। সাধারণভাবে চলাফেরা করা তার পছন্দ ছিলো। তিনি সারাজীবন সৎভাবে জীবনযাপন করেছেন, মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেছেন, কারো কোনো ক্ষতি করেননি। “কারো উপকার করতে না পারো, কখনোই কারো ক্ষতি কোরো না।” ছোটোবেলা থেকেই এটা সবসময়ই বাবার মুখে শুনে এসেছি।বাবা তাঁর বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনসহ সব বয়সী মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসতেন। বাড়িতে কেউ এলে কখনোই তাঁকে কিছু না খাইয়ে বাবা বিদায় দিতেন না। আপ্যায়ন করতে তিনি ভালোবাসতেন।

ছোট বেলায় বাবা যেমন আদর করতেন, তেমনি শাসনও করতেন। অন্যায়কে পশ্রয় দিতেন না তিনি কখনও। সব সময় শিখিয়েছেন- চরিত্রবান হতে হবে, সৎপথে চলতে হবে। লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হতে হবে। তাঁর স্বপ্ন ছিল আমরা যেন পড়ালেখা শেষ করে ‘মানুষের মত মানুষ’ হতে পারি। পড়ালেখা করেছি, ‘মানুষ’ হতে পারব কিনা জানিনা। শুধু বলতে পারি তার প্রত্যাশা পূরণে আমি আজও নিরন্তর সাধনায়।

বাবা আমাদের জন্য তার আদর্শ রেখে গেছেন। না, আদর্শ মানে গালভরা কিছু নয়। সামান্য নিয়েও সততার শক্তিতে আর ভালোবাসায় কিভাবে সবকিছু কানায় কানায় ভরিয়ে রাখা যায়, এ শিক্ষা তো দিয়ে গেছেন। ছোট্ট একটা জীবন আনন্দময় করার জন্য সততার চেয়ে বড় আদর্শ আর কী হতে পারে।

প্রতিটি সন্তানের কাছে এক শ্বাশত, মহান ও গভীর অনুভূতিপূর্ণ শব্দ হলো বাবা। সন্তান, কিংবা পরিবার, সবার কাছেই বাবা আশ্রয়ের নাম, নির্ভরতার প্রতীক। বাবার অবদান, ত্যাগ, স্নেহ, ভালোবাসা সকল তুলনার ঊর্ধে। পিতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক কখনো শ্রদ্ধার, কখনো ভয়ের আবার কখনো বা বন্ধুত্বের। পৃথিবীর সব সন্তানের কাছেই তার মা-বাবাই শ্রেষ্ঠ। আমার কাছেও তাই। পৃথিবীতে অন্য আট-দশ জন বাবা থেকে আমার বাবা একটু আলাদা। কারণ বাবার চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা সবকিছু ভিন্ন রকম। পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষকে দেখেছি নিজের স্বার্থের জন্য মানুষের উপকার করে। কিন্তু সবসময় আমার বাবাকে দেখতাম নিঃস্বার্থভাবে মানুষের উপকার করতে। প্রয়োজনে নিজের ক্ষতি করে হলেও মানুষকে সাহায্য ও সহযোগিতা করত। তার সঞ্চয় ছিল শুধু মানুষের ভালোবাসা। আজন্ম লোভ ও লালসার ঊর্ধ্বেব থেকে গণমানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। সেবার দ্বারা ও মহৎ কর্মের মাধ্যমে আলোর প্রদীপ হাতে নিয়ে মানুষটি অবদান রেখেছিলেন, সে মানুষটি আজ তার নিজ গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত। বাবার মৃত্যুর পর অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাসায় তাঁরা এসেছেন। দেশের নানা প্রান্ত ও দেশের বাইরে থেকে ফোন করেছেন। বাবার প্রতি তাঁদের যে গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি দেখেছি, তা অতুলনীয় ও হৃদয়স্পর্শী। ভালোবাসার সম্ভবত একটি তরঙ্গ আছে। বাবা যেমন মানুষকে ভালোবাসতেন, তারাও তেমনি ভালোবাসতেন বাবাকে। ভালোবাসার সেই অদৃশ্য তরঙ্গ সবাইকে স্পর্শ করত।
বাবা সব সময় এত অকৃত্রিম, অনাড়ম্বর ও সহজভাবে থাকতেন যে তাঁর হৃদয়ের বিশালতা, গভীরতা ও প্রজ্ঞাসহ বহুকিছুই আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি।মানুষকে ভালোবাসলে, তাদের জন্য কাজ করলে ও জীবন উৎসর্গ করলে মানুষ ভালবাসায় তার প্রতিদান দেয়। হয়ত আব্বার অনেক ভুলত্রুটি ছিল, ভুলত্রুটি ছাড়া তো কোন মানুষ নেই। আব্বার জানাজায় অনেক মানুষ এসেছিলেন । সবাই আব্বার জন্য আল্লার কাছে দোয়া করেছেন, একজন ভাল মানুষ হিসেবে তাঁর হয়ে মাফ চেয়েছেন।

বাবা আর ফিরবে না। আমিও চলে যাবো। ফিরব না। আজকে যারা বেঁচে আছি একদিন সবাই চলে যাবো, কেউ ফিরব না। তবে যত দিন আছি, এ ধরাধামে তত দিন তো বাবা হারানোর ব্যথা বয়ে বেড়াতে হবে।
তবুও সব ব্যথা, সব যন্ত্রণা ছাপিয়ে যদি বাবার মতো হতে পারতাম। বাবার মতো উদার মনের মানুষ। মহৎ হৃদয়ের অধিকারী। যদি তার স্বপ্নের সমান বড় হতে পারতাম।আব্বা নেই! তার অনুপুস্থিতি আমাদের মাঝে বিরাট শুন্যতা তৈরি করেছে। আল্লাহ যেন তার অসম্পূর্ণ কাজ গুলি আমাদের দ্বারা পূর্ণতা দান করেন।

আজ থেকে সাত মাস আগে আমার আব্বা আলহাজ্জ্ব কে.এম আবদুল করিম (রাহিমাহুল্লাহ) দুনিয়া থেকে চির বিদায় নিলেন। হে আল্লাহ! তোমার বান্দাহ কে তুমি এই রহমত,নাযাত,মাগফিরাতের মাসের উছিলায় ক্ষমা করে দিও, (রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছাগিরা)।

ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে মানুষের মনে তার জন্য যে ভালোবাসা পয়দা করে দিয়েছো, সেই তাকে মাটির কবরে তোমার কুদরতি ভালোবাসায় সিক্ত করো । যে সম্মান দুনিয়ায় তুমি তাকে দান করেছো, শেষ বিচারের দিনে মেহেরবানী করে তার সম্মান আরো বাড়িয়ে দিও । নশ্বর এ পৃথিবীতে তুমি তাকে দয়াকরে যে সুখ, শান্তি, আরাম দিয়েছো, চীরস্থায়ী জান্নাতে মায়াকরে তাকে তা দান করো । জান্নাতে তোমার পাশে একটি ঘর দিও । আমিন।

এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের মধ্যেই আছেন। তুমি আজ বেচে আছ মানুষের ভালোবাসায়, বিশ্বাসে। সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হিসেবে বেচে থাকবে আমাদের মাঝে আজীবন। কেমন আছেন আমাদের বাবা তা হয়তো আমরা দেখতে পাইনা , তবে অনুভব করি তিনি সব সময় আমাদের পাশেই আছেন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কৃপায় অনকে ভাল থেকে আমাদের অনুপ্ররেণা দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদরে প্রিয় “বাবা”র জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। আল্লাহ রব্বুল আল-আমীন যেন তাকে জান্নাত বাসী করেন।

বাবা আজ তুমি নেই , আজ তুমি ছাড়া আমরা যে কি অসহায় তা বুঝতে ভুল হয়না একটি বার। তুমি ছিলে আমাদের প্রান আর আমরা ও ছিলাম তোমার প্রান। আল্লাহ আমার বাবার সকল পাপ মাফ করো, কবরের আযাব মাফ করো, তার রূহের শান্তি দাও, তাকে জান্নাত দাও ।

রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানি ছগীরা ।

‘‘হে আমার রব! তাঁদের প্রতি দয়া কর যেভাবে শৈশবে তাঁরা আমাদের প্রতিপালন করেছিলেন।’’

(সূরা বনি ইসরাঈল- ২৪)

লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম, কলামিষ্ট, সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ ।