প্রবীর সিকদার


মাঝে মধ্যেই কিছু আঁতেল খুবই বিজ্ঞের মতো বলে থাকেন, শেখ মুজিব ৭ মার্চ ১৯৭১ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করলেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তরও তারাই দিয়ে দেন, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে।

স্বাধীনতা যুদ্ধ এতো সহজ নয়। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের আওয়ামীলীগ বিশাল জয় পেয়ে যাওয়ায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে ধরে নেওয়া হচ্ছিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের হাতেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তুলে দিবেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ ভাবে পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তরের নির্বাচন, সেটি বাঙালির স্বাধীনতার ম্যানডেট ছিল না। ওই বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ১৯৭১ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার প্রুস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়ার পরও পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সাথে আলোচনা চালিয়ে যান। সেই আলোচনা ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া, ওই দিন রাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়া ও ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ভেতর দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে যায় যে, পাকিস্তানী সামরিক জান্তা নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়ায় তাঁর অর্থাৎ শেখ মুজিবের সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনো কিছুই করার ছিল না। আর এর ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা আন্দোলন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সহানুভূতি আদায় করে নেয়। আর যদি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী জান্তার সাথে ক্ষমতা হস্তান্তরের কৌশল নিয়ে আলোচনা না করে ৭ মার্চেই বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন, তবে তাতে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বীকৃতি আদায় হতো না, সেটা হতো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিচ্ছিন্নতা আন্দোলন যে এক জিনিষ নয়, সেটা বঙ্গবন্ধু খুব ভালো করেই জানতেন। তিনি একটি পরিকল্পিত স্বাধীনতা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যদি সেদিন এই পরিপক্কতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হতেন, তবে আমাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে হতো।

স্যালুট বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আর এই কারণেই আমার বিবেচনায় কখনো বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন নিজেই পুরো বাংলাদেশ, কখনো হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের চেয়েও বড় একটি ক্যানভাস, যেখানে কোটি কোটি বাঙালির স্বপ্ন-সাধ গ্রন্থিত থাকে।