চৈাধুরী আবদুল হান্নান : পঞ্চাশের দশকে আমার বাবা মসজিদের ইমাম ছিলেন। শিশুর জন্ম হলে ডাক পড়তো - মিলাদ পড়ানো আর নবজাতকের নাম রাখার জন্য। দীর্ঘদিন যাবৎ নাম রাখার কাজ সম্মানের সাথেই করে আসছিলেন। এক সময় বিপত্তি দেখা দিল, তার বয়স বাড়লো-৮০ পার হলো।

নতুন নাম নির্বাচনে অসংগতি দেখা গেল। তখন তো আর নবজাতকের নামের তালিকার বই ছিল না। মহাবিপত্তি ঘটলো আমার মা যখন প্রতিবাদ করলেন, দেখলেন আমাদের ভাই বোনের নামে নাম মিলিয়ে পাশের বাড়ির শিশুর নাম রেখে এসেছেন।

আসলে এটা ব্যক্তির দোষ নয়, বয়সের স্বাভাবিক পরিণতি।

৮৪ বছর বয়সে আমাদের অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বাজেটে নানা গোঁজামিল, অসংগতি থাকবে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। গত ১লা জুন বাজেট ঘোষনার পর থেকে অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা অব্যাহত আছে। বাজেট আলোচনা, সমালোচনার চেয়ে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা হচ্ছে বেশি। ইতিপূর্বে সরকারের বাজেট ঘোষনার পর পরই বিরোধীদলের বাজেট বিরোধ রুটিন মিছিল লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু বর্তমানে রাজনীতির ময়দানে বিরোধী দলগুলোর কর্মকান্ড এক প্রজার নিষ্প্রভ। কিন্তু এক্ষেত্রে এক ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। তা হলো, সরকারের এমপি-মন্ত্রীগনই এবার বাজেট সমালোচনায় মুখর।

অনেকেই মনে করেন বাজেট উপস্থাপানায় সতর্ক হলে সামালোচনার তীব্রতা এত ব্যাপক হতো না। জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট, এক লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা থাকলে তারা সম্পদ শালী এ জাতীয় বক্তব্য আগুনে ঘি ঢেলেছে।

বাজেট প্রনয়নের পূর্বে অথমন্ত্রীকে ভাবতে হয় সম্ভাব্য ঘাটতি পূবনের ক্ষেত্র নিয়ে। কোন কোন খাতে নতুন করে কর বসানো যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে কর বৃদ্ধি কারা যায় ইত্যদি। মদ, গাঁজাসহ কিছু পণ্যের ব্যবহার ঠেকাতে আবগারি শুল্ক বসানো হয়।

এবার ব্যাংকিং এ আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে যা অনেকেই অগ্রহনযোগ্য মনে করছেন। ঘাটতি পূরনে ব্যাংক ব্যবস্থাকে মূল টার্গেট করা হয়েছে। তাছাড়া ব্যাংক হচ্ছে বর্তমানে কর আদায়ের অন্যতম বড় খাত। ব্যাংক সেবায় ভ্যাট ও মুনাফার ওপর উৎস কর বাবদ আদায়ের পরিমাণ বছরে ৭ হাজার পাঁচশত কোটি টাকা। এর বাইরে দেশে কর্মরত ৫৭ টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চ হারে করপোরেট কর দিয়ে থাকে। এর পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, ভ্যাট, উৎস কর ও করপোরেট কর বাবদ ব্যাংক খাত থেকেই ১৫ হাজার ৫ শত কোটি টাকা আয় হয়। এতো সোনার ডিম পাড়া হাস।

অর্থমন্ত্রী আবগারি শুল্ক বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা করেছেন, তার ৮০ শতাংশই আসবে লাখ টাকা থেকে কোটি টাকার নিচের হিসাবধারীদের থেকে। এ জনগোষ্ঠির মধ্যে করা আছেন? অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আমানতকারী, সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষ, সারকারি বেসরকারি অবসর প্রাপ্ত কর্মচারী, জীবন যুদ্ধে হিমশিম খাওয়া নারী এবং এ জাতীয় মানুষজন।

আর এ জনতার কাতারে নেই কারা? ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারী নেই, নেই বিদেশে অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতি ও কারসাজি করে সরকারের অর্থ লুটে নেওয়া বড় বড় বিত্তবানরা। তারা কেবল অঢেল অর্থবিত্তের মালিক নন, সমাজের মাথা, সরকারের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রক।

অর্থমন্ত্রী ট্যাক্স, শুল্ক বাড়াতে প্রথম গ্রুপকে বেছে নিয়ে বুদ্ধি মানের মত কাজ করেছেন। কে ঝাামেলা বাড়াতে চায়? ঘরের মুরগি জবাই করাই ভাল। তাদের মাথায় বোঝাটা ভারী হলে ক্ষতি নেই। তাতে ওদের মেরুদন্ড বাঁকা হলেও জোরদার কোনো আন্দোলন হবে না। কিন্তু দ্বিতীয় গ্রুপের দিকে ‘কু’ দৃষ্টি দিলে খবর আছে। অনেকে তো বলেই ফেলেছেন, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারীদের প্রতি অর্থমন্ত্রীর এক ধরনের নরমভাব দীঘদিন থেকেই লক্ষ্য করা গেছে। এবারও দেখা গেছে দুর্নীতিবাজ, অর্থলুটকারী, অর্থ পাচারকারীদের তিনি বিরক্ত করা থেকে কেীশলে বিরত রয়েছেন।

যারা নিয়মিত কর প্রদান করেন তাদের স্বস্তি না দিয়ে আরও কর শুল্ক বাড়ানো নৈতকতা বিরোধী। আমরা আশা করতে চাই সমালোচনার মুখে অর্থমন্ত্রী বাজেটের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশোধন করতে মনযোগী হবেন। তবে এ লেখার মাধ্যমে আমি অনুরোধ রাখতে চাই ব্যাংকে যাদের আমানত এক কোটি টাকার মধ্যে তাদের করের বোঝা বৃদ্ধি না করে পূর্বেরটা বহাল রাখা হোক এবং সে ক্ষেত্রে সম্ভাব্য আয়ের ঘাটতি পূরনের জন্য প্রকৃত সম্পদশালী ও প্রভাবশালীদের দিকে সরকার হাত বাড়াতে পারে।

তাতে অন্তত একটা বার্তা সৃষ্টি হবে যে সারকার দরিদ্র বান্ধব হওয়ার চেষ্টা করছে।

লেখক :অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম (সোনালী ব্যাংক)