মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া : মোগো কি আর হেই বয়স আছে, অহন আর গায়-গতরে জোড় পাইনা আগের মতো। অল্পতেই হাপাইয়া উডি। সাগরে তুফানের লগে বুকটাও অহন ধরফর করে। জাল টানতেও কষ্ট হয়। আর বুড়া মানু কি জোয়ান পোলাগো লগে কুলাইয়া ওঢে। তাই ছেড়া জাল সেলাইয়া চলে আমাগো বাইচ্চা থাহা। রোজা, তাই হারাদিনই জাল সেলাই। সন্ধায় কিছুতো ঘরে নেতে হইবে এ কথাগুলো বলেন, ওয়াজেদ আলী। সামনে ঈদ তাই উপকূলীয় জেলে পল্লীগুলোতে শেষ মুহুতে চলছে ছেড়া জাল সেলাইয়ের বস্ত মৌসুম।

ছোট্ট একটি ধারালো চাকু ও সুতা ঢোকানের একটি থুড়িয়া দিয়ে তারা একেরপর এক জাল সেলাই করে যাচ্ছে। সাগরে মাছ ধরা শেষে উপকূলে ফিরে আসা ট্রলারের ছিড়ে যাওয়া জাল সেলাই করে এখন তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। সাগরে জলদস্যুদের একেরপর তান্ডব, লুটপাট ও জেলে অপহরনের ঘটনায় ভীত উপকূলীয় এলাকার শতশত জেলে এখন তাদের পেশা ছেড়ে বিকল্প পেশায় ঝুঁকে পড়ছে। অনেক জেলে এখন ছেড়া জাল সেলাই ও নতুন জালের দড়ি লাগানোকে জীবিকা নির্বাহের প্রধান পথ বেছে নিয়েছে।

জেলেদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কলাপাড়া উপজেলায় জেলেদের ছেড়া জাল সেলাই ও নতুন জালের দড়ি লাগানোর কাজ করে জীবিকা চলছে অন্তত এক হাজার পরিবার। সাগরে কিংবা সাগর মোহনা সংলগ্ন এলাকায় যখন জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে তখন এদের মজুরি বাড়ে। আবার যখন সাগরে মাছ শিকার বন্ধ থাকে তখন মজুরি কমে যায়। এমনকি তখন দুইশ’ টাকা থেকে মজুরি কমে মাত্র ৮০/৯০ টাকায় নেমে আসে।

উপজেলার গোলবুনিয়া গ্রামের ওয়াজেদ আলী (৫৫), মঞ্জুপাড়া গ্রামের ছোবাহান কবিরাজ (৬০), চারিপাড়া গ্রামের আনছার হাওলাদার (৬০), নুর সাঈয়েদ খলিফা (৫০), পাটুয়ার শাহআলম মাতুব্বর (৬০) ও নয়াকাটা গ্রামের বাদল বয়াতী (৩৫)। তারা জানান, দিনভর দড়ি লাগিয়ে একেকজনের মজুরি দেড়শ/দু’শ টাকা। নতুন জালে লাইলনের দড়ি লাগানো এবং ছেড়া জাল সেলাই করেই এদের জীবিকা চলে। জেলেদের জাল ছিড়লে এদের জোটে কর্মসংস্থান।

মঞ্জুপাড়া গ্রামের ছোবাহান কবিরাজ জানান, তিনি আট/দশ বছর ধরে পুরনো ছেড়া জাল সেলাই করছেন। আগে মাত্র একশ’ টাকা মজুরি ছিল তাদের। মাছের জো’ থাকলে মজুরি বাড়ে। আবার জো’ কেটে গেলে মজুরি কমে যায়। সাগর ও নদীর পাড়ে বসেই তাদের এই কাজ করতে হয়।

উপজেলার চারিপাড়া, গাজীর খাল স্লুইস, মুন্সিপাড়া, বুড়াজালিয়া, ঢোস, চর ধুলাসার, চর গঙ্গামতি, ইকোপার্ক, কুয়াকাটা, মাঝিবাড়ি, খাজুরা, লেম্বুরচর, নাইয়রিপাড়া, আলীপুর, মহীপুর, গোড়াখাল এসব এলাকায় ছেড়া জাল সেলাই কিংবা নতুন জালের দড়ি লাগিয়ে সহস্রাধিক পরিবারের জীবিকা চলছে। নাইয়রিপাড়া এলাকায় অনেক জেলে পরিবারের মহিলারা এই কাজটি করেন। একেকটি শাইন জালে দড়ি লাগাতে চারজনের ৫/৬দিন পার হয়ে যায়। প্রায় এক হাজার হাত লম্বা একেকটি জাল।
সাগর থেকে একেকটি ট্রলার উপকূলে নোঙর করার সাথে সাথে তাদের ট্রলারের জালটি তুলে দেয় এদের হাতে। পুনরায় সাগরে যাত্রার আগেই জালের সকল ছেড়া অংশ এরা মেরামত করে দেয়। এ কারনে এখন তাদের দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের।

এ পেশায় জড়িত মিজানুর মিয়া, আকরাম জাইল্যা সহ একাধিক জেলে জানান, তারাও আগে সাগরে মাছ ধরতেন। কিন্তু এখন অনেকের বয়স হয়েছে, সাগরে যে এখন চরম অশান্তি (ট্রলারডুবি,ডাকাতি) তাই শেষ বয়সে আর অপঘাতে মরতে চাইনা। তাই বাধ্য হয়েই সংসারের হাল ধরতে এ পেশা বেছে নিতে হচ্ছে। এতে আয় কম হলেও জীবনের তো নিরাপত্তা আছে।

(এমকেআর/এএস/জুন ২২, ২০১৭)