মো. আমির হোসেন


মুক্তিযুদ্ধ শেষে ২৭০০ কোটি টাকার অস্ত্র-সরঞ্জাম লুট করেছিলো ভারতীয় বাহিনী! ১২ মে ১৯৭৪ এর অমৃতবাজার পত্রিকায় এমন একটি সংবাদ প্রচার করা হয় বলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের একটি অংশ স্বাধীনতার এতো বছর পরেও ব্যাপক হারে প্রচারণা চালিয়ে যচ্ছে। ভারত বিদ্ধেষ উষ্কে দিতে ভারত বিদ্ধেষীদের এটি একটি মোক্ষম অস্ত্র। ধরে নিলাম সংবাদটি অমৃতবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সংবাদটির ধরণ কেমন ছিল? অনেক সংবাদ এমন হয় যে সংবাদে কারো উদ্বৃত্তি কেবল প্রকাশ করা হয়। যার ভিত্তিগত সত্যতা অনেক সময়তেই থাকে না। আমি নিজে অনুসন্ধান করেছি, যেখানে কেবল উক্ত অমৃতবাজারের রেফারেন্স দিয়ে কেবল অভিযোগই করা হয়েছে। যুক্তিসংগত প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি।

এমন অভিযোগ নতুন নয়। ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী যখন খুলনা মুক্ত করে সেই সময় মুক্তিযুদ্ধে কনিষ্ঠতম মেজর ও পরবর্তীতে জাসদ নেতা মেজর (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল জলিল ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের অভিযোগ আনে। তাকে তখন গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর সঙ্গে আরো যারা গ্রেপ্তার হোন তারা হলেন, ঐ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা সুলতান উদ্দিন আহমদ ও মো. খুরশীদ। খুরশীদ ও সুলতান উদ্দীন অভিযোগ থেকে খালাস পেলেও জলিলকে সামরিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ওই আদালতের প্রধান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও পরবর্তী জাসদ নেতা লে. কর্ণেল আবু তাহের। তিনি জলিলকে অব্যাহতি দিয়ে দেন। জলীল সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি মিথ্যা অভিযোগকারী মেজর জলিল সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা হওয়া উচিৎ। জাসদের এই নেতার চুয়াত্তরের গোড়ার দিকে পাকিস্তানে ভুট্টো ও তাঁর দলের সঙ্গে একটি গোপন আতাতের কথা প্রকাশ পায়। বলা হয়, ‘চুয়াত্তরের গোড়ার দিকে মেজর জলিল ভয়েস অব আমেরিকা, ইউপিআই, এবং ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিনিধি আমানুল্লাহর সঙ্গে আলোচনাকালে তাঁকে (আমানুল্লাহকে) পাকিস্তানে ভূট্টো ও তাঁর দলের সঙ্গে যোগাযোগের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। জলিল আমানুল্লাহকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনার সময় জলিলের সঙ্গে থাকেন এবং তাঁকে সাহায্য করেন।’

এটাই ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি মিথ্যা অভিযোগকারীদের আসল চরিত্র। ভারত বিদ্ধেষী বক্তব্য ও মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে জাসদ আসলে চাচ্ছিল মুজিবের জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামিয়ে নিজেদের সস্তা জনপ্রিয়তা তৈরী করা। এই সময় তাঁদের সাথে যোগ দেয় পাকিস্তানপন্থী ও চীনপন্থী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের একটি বড় অংশ। অভিযোগ ওঠে, সশস্ত্র লড়াই সংগঠিত করতে জাসদ নেতৃত্বে সিআই এর লোক বলে কথিত জনৈক পিটার কাস্টারের নিকট হতে ৪০ লক্ষ টাকা গ্রহন করে। জাসদের পত্রিকা ‘গণকন্ঠ’ বঙ্গবন্ধু সরকার ও ভারতের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে মিথ্যাচার করতে থাকে। তাঁর কিছু নমুনা তুলে ধরা হল।

গুজোব রটানো হয়, বঙ্গবন্ধুর সরকার ভারত সরকারকে যে পরিমান নোট ছাপতে দিয়েছিল ভারত সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের অর্থিনীতিকে দেউলিয়া করে দেবার জন্যে তাঁর দ্বিগুণ নোট ছাপিয়েছে। ভারত থেকে মোট ৩৫০ কোটি টাকা ছাপানো হয়েছিল। আওয়ামীলীগ সরকার এর সত্যতা জাচাই করতে পুরোটাই তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে দেখা যায় বাংলাদেশ ব্যাংক কতৃক মূলত ইস্যুকৃত মোট অঙ্কের চাইতে ৫৩ লক্ষ ৫৪ হাজার ৪৮০ টাকা কম জমা পড়েছে। এতে পরিষ্কার প্রমাণিত হয় যে দ্বিগুণ ছাপা বা নোট ছাড়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ গুজব।

জাসদ, হলিডে চক্র, এবং মাউলানা ভাসানী এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিসমূহ প্রচার করতে থাকে যে, মুক্তিবাহিনীর সাথে বাংলাদেশে যে মিত্রবাহিনী প্রবেশ করেছিল তারা যাবার সময় শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে সকল কলকব্জা খুলে নিয়ে গেছে। ফলে দেশব্যাপী শিল্প উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এই সকল শিল্পকারখানার অধিকাংশ মালিকই ছিল তখন পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিগণ। সরকারের এক জরিপে দেখা গেছে, পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি ও বিরাট কারবার প্রতিষ্ঠান ওয়ালারা বাংলাদেশ থেকে কলকব্জা, যন্ত্রপাতি, ব্যাংক আমানত ও নগদ অর্থে ৭৮৫ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়ে গেছে। বহুক্ষেত্রে শিল্পপতিরা সমগ্র কারখানা বা কলকব্জা অংশে অংশে খুলে পাকিস্তানে পাচার করেছে। ফলে স্বাধীনতার পরপরই অনেক শিল্পকারখানা চালু করা সম্ভব হয়নি। এই প্রকৃত অবস্থা গোপন রেখে সারাদেশে ভারতের উপর এসব দোষ চাপানো হল।

মওলানা ভাসানী অভিযোগ করে বলেন, কলকাতার রাস্তায় বাংলাদেশের মোটরযানে ভর্তি হয়েগেছে। কথাটির ভিত্তি মিথ্যার উপর দাঁড় করানো। স্বাধীনতা যুদ্ধে কেউ কেউ গাড়ি নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এইসকল গাড়িকে সনাক্ত করে কলকাতা পুলিশ WJB সংকেতে পৃথক নম্বর দিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলে দেশে প্রত্যাগমনের সময় ঐসকল গাড়ি তারা সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশে ফিরে আসে। বিচারবিশ্লেষণ না করেই অভিযোগ করা হয়েছিল প্রায় ৬০০০ কোটি টাকার মালামাল ভারতে স্থানন্তরিত করা হয়েছে। সরকারী পর্যায়ের লেনদেনের হিসাবে বিশ্বব্যাংক ১৯৭৬ সালে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৭২ সনের জানুয়ারী থেকে ১৯৭৫ সনের জুন পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য দিয়েছে ১৩৫ কোটি টাকারও বেশি।

এই সকল কিছুই ঘটেছে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে মুজিব সরকারকে অপসারণের কৌশল হিসেবে। পিছন থেকে ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছিল আমেরিকা, চীন ও পাকিস্তান। মূল টার্গেট ছিল মুজিব হত্যা। ব্যক্তি হত্যার আগে চরিত্র হত্যার কৌশল তো সিআই এর অতি প্রাচীন কৌশল। ১৯৭৪ সালে মিসেস আলেন্দে ভারতে এসেছিলেন। সেখানে সাংবাদিক আব্দুল গাফফারের সাথে এক আলাপচারিতায় সিআই এর ‘সেট প্যাটার্ণ’ সম্পর্কে বলেন। কোন পপুলার গভর্মেন্টকে ওরা ধ্বংস করার জন্য প্রথমে সেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙ্গে দেয়। নানা গোলমাল শুরু করে। শ্রমিক ধর্মঘট উষ্কে দেয়। ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এইভাবে পপুলার নেতা বা গভর্মেন্টের জনপ্রিয়তা নষ্ট করে দিয়ে তাঁর পর খুনখারাপি শুরু করে। জনমতকে বিভ্রান্ত করে নিজেদের দিকে নেয়। প্রথমে ওরা ভাব দেখায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এসব করা হচ্ছে। তাঁর পর ধিরে ধিরে মিলিটারির পক্ষ থেকে ওদের বাছাই করা লোকটিকে ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটরের আসনে বসিয়ে দেয়। এইভাবে কংগোতে লুমুম্বাকে মেরে ওরা বসিয়েছে মুবুতুকে। ইন্দোনিশিয়ায় সুকর্ণকে সরিয়ে ওরা বসিয়েছে সুহার্তোকে। চিলিতে আলেন্দেকে সরিয়ে বসিয়েছে পিনোচেকে। মিসেস আলেন্দে শেখ মুজিবকে নিয়েও সঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। ৭৫ এর ১৫ আগষ্ট মুজিবকে সরিয়ে এর কিছুদিন পরেই জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় বসানো হয়। মিসেস আলেন্দের বলা সিআই এর সেই ‘সেট প্যাটার্ণ’ ২০১৭’তেও যে অব্যাহত নেই সেটাই বা কে বলবে?