আবিরের রত্নগর্ভা

দুপুরবেলা আবিরের মুঠোফোনে তার মা ফোন দিয়েছে।
- বাবা, ক্যাম্পাস থেকে বাসায় গেছিস?
- জী মা এইতো যাচ্ছি।
- তুই কি হেঁটে যাচ্ছিস? তোর হাঁটার শব্দ শোনা যায়!
- না, মা। এই তো আমি রিক্সায়, গাড়ীর শব্দ শুনতে পাচ্ছো না?
- শুনছি। তোর বন্ধু বললো সকালে না খেয়েই ক্যাম্পাসে বেড়িয়েছিস।
- কই না'তো মা! আমি তো সকালে খেয়েই বেড়োলাম। বুয়া, সকালে গরম রান্না করেছিল।
- কিন্তু শুনলাম বুয়া নাকি ছুটিতে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেছে?
- সরি, মা। এখুনি খেয়ে নিচ্ছি।
- তুই গত একসপ্তাহ অসুস্থ ছিলি আমাকে জানাসনি কেন?
- সরি, মা আসলে---
- আসলে কী? আমি টেনশনে থাকবো তাই বলে আমাকে জানাবি না?
- আচ্ছা মা বাদ দাও না ওসব! আমি তো এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
- বাবা নিজের খেয়াল রাখিস। আর শোন আবির, তোর বাবার গ্যাস্টিকের ব্যাথাটা বেড়েই চলেছে এদিকে তোর ছোট বোনটার বিয়ের কথা বার্তাও চূড়ান্ত হয়ে গেছে। কি যে করি –
- আচ্ছা মা, আমি থাকতে তোমার টেনশন কিসের? আমি আছি না!
- ঠিক আছে এখন রাখ বাবা। আর শোন ঠিক ভাবে খাওয়া-দাওয়া করবি আর নিজের খেয়াল রাখবি।
- আচ্ছা মা, বাবার খেয়াল রেখো।
দেখতে দেখতে আবিরের ছোটবোন বিনুর বিয়ের দিন চলে এসেছে। আবিরও শহর থেকে গ্রামে চলে এসেছে। বিনুর জন্য লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি আনতে ভুল করেনি আবির। আজ বিয়ে। বিয়ের সবরকম রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন। বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না বলে আবির, বাবার জন্য অষুধ আনতে বাজারে গেছে। বাজার থেকে বিয়েবাড়ির সরগরম শোনা যায়। হঠাৎ সরগরমটা একটু বেশীই বেড়ে গেলো। অনেকের ধারনা বাড়িতে বোধ হয় বরযাত্রি চলে এসেছে। কিন্তু এতো তারাতারি তো বরযাত্রি আসার কথা না। আবির তারাতারি বাড়ি ছুটে এসেছে। ছুটে এসেছে আশেপাশের লোকগুলোও। বিনুর বিয়েতে যাদের আসার কথা ছিলোনা তারাও চলে এসেছে। একি মূহুর্তেই বাড়িতে তুলকালাম কান্ড। আবিরের বাবা চলে গেছে না ফেরার দেশে।আবিরের বাবার মৃত্যুর সংবাদ মসজিদের মাইক থেকেও ভেসে আসছে। আবির আর বিনুর চেয়ে তার মা বেশী শোকাত। বিনুটা বেনারসি শাড়ি পরেই বারবার মূর্ছা যায় তার মৃত বাবার শোকে। বরযাত্রিরা এসে মিলে গেছে এলাকার শোকসন্তপ্ত মানুষের সাথে। বিয়ের দিন-তারিখ অঘোসিত পেছানো হলো। বিকেল থেকে পরবর্তী একসপ্তাহ পর্যন্ত বাড়িটা নিশ্চুপ হাহাকার। আবির বারান্দায় মাটির দাওয়া বসে আছে বাধ্য ছেলের মত মাথানিচু কোরে। আবিরের মা সাদা কাপড় পরে আবিরের পিছনে এসে দাড়িয়েছে আবির টের পায়নি। পিঠে হাত রেখে যখন বলছে বাবা তোর পরীক্ষা এ মাসেই হওয়ার কথা ছিলো শহরে যাবিনা?
- যাবো মা। আরও কিছুদিন পরে। তোমাকে, বিনুকে এভাবে রেখে যেতে মন চায় না।
- যা হবার হয়ে গেছে। যা বাবা এবার পড়াশুনায় মন দে।
এভাবে আরও কিছুদিন পেরিয়ে গেছে আবিরের। তার মা আবার একদিন আবিরকে বলছে আবির তুই পরীক্ষা দিলিনা? তোর বন্ধুরা পরীক্ষা দিয়ে ছুটিতে গ্রামে চলে এসেছে।
- মা, পরে দিবো পরীক্ষা।
- কিন্তু তুই তো আমাকে মিথ্যা বলিস না কখোনো! গত সপ্তাহেও তো একই কথা বলেছিস। বল কেন মিথ্যা বলেছিস?
- মা, মিথ্যা কথা তো তোমার কাছ থেকেই শিখেছিলাম।
- কি বলছিস, আমি তোকে মিথ্যা শিখিয়েছি?
- জী মা। আমি তোমার কাছ থেকেই মিথ্যা শিখেছি। ছোট বেলায় তিনটি রুটি বানিয়ে আমাদের ভাই-বোনকে
খাওয়াতে। আর যখন বলতাম মা তুমি খাবে না? তুমি পাতিলে শুধু পানি দিয়ে চুলোয় বসিয়ে বলতে এইতো ভাত রান্না হচ্ছে, আমি পরে খাবো। তোরা খেয়ে নে। বাবার চাল কেনার টাকা থেকে প্রতিদিন কিছু টাকা বাঁচিয়ে আমাদের বইখাতা কেনার টাকা ম্যানেজ করতে, বাবা জিগ্বাসা করলে মিথ্যা বলে এড়িয়ে যেতে। বছরে একবার বাবার দেয়া তোমাকে কাপড় ক্রয়ের টাকাগুলো আমাদের স্কুলের বেতন হিসেবে দিয়ে দিতে আর ববাকে বলতে কাপড় কিনেছি পরে পড়বো। মা, আরও কত্তরকম মিথ্যা কথা বলতে দেখেছি তোমাকে। কিছু বলার মত ভাষা ছিলোনা। আজ বাবা নেই লেখাপড়া দিয়ে কি হবে, মা? বিনুর বিয়ের সময়ই তো আমার পরীক্ষা ছিলো। আমি আমার পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকা দিয়ে বিনুর বিয়ের ব্যবস্থা করেছি। তুমিই মা, তুমিই মিথ্যেবাদি রত্নগর্ভা। বলো, তখন কি আমার পরীক্ষা দেয়া উচিত ছিলো?
আবিরের প্রশ্নের কাছে তার মা রত্নগর্ভার উত্তর সেদিন প্রতিবন্ধীরুপ নিয়েছিলো।