শরীয়তপুর প্রতিনিধি : হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার এক বছর আজ। কিছু বিপথগামী উগ্র জঙ্গির হাতে ওই দিন ইতিহাসের জঘন্য ও নৃশংসতম নারকীয় হত্যাকান্ডে প্রান গিয়েছিল দেশী-বিদেশী অনেক লোকের। আইন শৃংখলা বাহিনীর লোকদের হাতেও মরতে হয়েছিল হামলাকারি হায়েনাদের। তাদের সাথে নিহত হয়েছিল রেস্তোরাঁর পিজা প্রস্তুতকারি শেফ সাঈফুল ইসলামকেও। সাঈফুলের পরিবারের দাবি, সে শুধুই একজন শেফ ছিল। কোন জঙ্গি কিংবা সাধারণ অপরাধের সাথেও জরিত ছিলনা। তবুও মৃত্যুর পরে জঙ্গী খেতাব দেয়া হয়েছে তাকে। হলি আর্টিজানে হামলার এক বছর পার হলেও আজো কান্না থামেনি সাঈফুলের পরিবারের। বিধবা মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে দেখতে দেয়া হয়নি তার মরদেহ।

মাত্র এক দিন পরেই ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসার কথা ছিল সাঈফুলের। দুই কন্যার জন্য কেনা হয়েছিল ঈদের পোশাক। সন্তান সম্ভাবা স্ত্রী ও মায়ের জন্যও সাধ্যমত সব কেনাকাটা শেষ করেছিল সাঈফুল। রাত পোহালেই শনিবার বাড়ি আসবে। সকলের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিবে ঈদ আনন্দ। কিন্তু ২০১৬ সনের ১ জুলাই শুক্রবার পশ্চিমাকাশে গোধুলী লগন শেষ হওয়ার আগেই দূর্ভাগ্য নেমে আসে সাঈফুল সহ অন্তত দুই ডজন তাজা প্রানের। পরিবারের সাথে ঈদ তো দুরের কথা বাবা দাদার বাড়ির মাটি টুকুনও তার ভাগ্যে জোটেনি।

ওই হামলায় নিহত সাঈফুলের লাশ সনাক্ত হওয়ার আগেই আইন শৃংখলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন মিডিয়াতে জঙ্গি বলে প্রচার করা হয়েছিল সাঈফুলকে । এ কারনে তার মরদেহটিও ফেরত দেয়া হয়নি পরিবারকে । নিহত সাঈফুলের স্ত্রী সোনিয়া তার তিনটি অনাথ শিশু সন্তান ও বিধবা শাশুড়িকে নিয়ে আজ খেয়ে না খেয়ে, অনাহার অর্ধহারে অপরের সাহায্য নির্ভর হয়ে কোন রকমে পার করছে জীবন।

সাঈফুলের পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার কলুকাঠি গ্রামের মৃত আবুল হাসেম চৌকিদারের ৫ সন্তানের মধ্যে সাইফুল ইসলাম চৌকিদার দ্বিতীয়। মাত্র ৬ বছর বয়সে এতিম হয় সাঈফুল। লেখাপড়ায় খুব একটা এগুতে পারেনি। হাই স্কুলের গন্ডি শেষ না করেই ধরতে হয়েছিল সংসারের হাল। এরপর ৯০ দশকের প্রথম দিকে আত্মীয় স্বজনদের সহায়তা আর বাবার রেখে যাওয়া শেষ সম্বল দুই বিঘা ফসলি জমি বিক্রি করে পাড়ি জমায় পশ্চিম জার্মানীতে।

দীর্ঘ ১০ বছর সে জার্মাানীতে থেকে সেখানকার বৈধ কাগজ পত্র না পেয়ে দেশে ফিরে আসে ২০০৪ সালে। জার্মানে থাকতেই একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করার সুবাদে শিখে নেয় পিজা তৈরির কাজ। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে এক প্রতিবেশীর সহায়তায় ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় পিজা তৈরীর কুক হিসেবে কাজে যোগদান করেন সাঈফুল। ১ জুলাই জঙ্গি হামলায় ৯ ইতালিয়ান নাগরিক, ৭ জাপানী নাগরিক, ১ জন ভারতীয় নাগরিক ও ২ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ ব্যক্তি নিহত হন। আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতেও নিহত হয় ৬ জঙ্গি। তবে নিহতদের মধ্যে শেফ সাঈফুলও ছিল। সাঈফুলকে পুলিশ জঙ্গি হিসেবে ঘোষনা দেয়ায় শত চেষ্টা করেও তার মরদেহ পায়নি পরিবারের সদস্যরা।

সাঈফুল নিহত হবার সময় সামিয়া (৯)ও ইমলি (৬) নামে তার দুটি কন্যা সন্তান ছিল। স্ত্রী সোনিয়া তখন ৬ মাসের অন্তসত্বা। সাঈফুলের মৃত্যুর তিন মাস পর তাদের একটি পূত্র সন্তান জন্ম নেয়। সে সন্তান হাসানের বয়স এখন ৯ মাস। আজ এক বছর পার হলো সাঈফুলের মৃত্যুর। কিন্তু ওই পরিবারের কান্না থামেনি আজো। সাঈফুলদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় নিহত সাঈফুল ইসলাম চৌকিদারের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার (২৭) তার দুই কন্যা সামিয়া(১০) ইমলি (৮) ও ৯ মাসের শিশু পূত্র হাসান ও বৃদ্ধা মা সোমমেহের বিবি বাড়িতে আহজারি করছেন।

সাঈফুলে মা সোমমেহের বিবি (৭০) বলেন, আমার ছেলে কোন অন্যায় কাজের সাথে কখনো জরিত ছিল না। সে শেফ এর পোষাক পরিহিত অবস্থায় মারা যায়। মেরে ফেলার পর আমার ছেলেকে জঙ্গি সাজানো হয়েছিল । আমি আমার বুকের মানিকের লাশটির জন্য মাসের পর মাস সরকারের লোকদের কাছে কান্নাকাটি করেছি। কেউ আমার ছেলের লাশটি ফেরৎ দেয়নি। ওকে আমি শেষ দেখাটি ও দেখতে পারিনি। আমি এখনো সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, আমার ছেলেকে জঙ্গি অপবাদ থেকে রেহাই দেয়া হোক।

সাঈফুলের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার বলেন, নিহত হওয়ার ২৪ দিন আগে ২য় রমজানে সে বাড়ি থেকে শেষ বারের মত কর্মস্থলে যায়। ২ জুলাই শনিবার শবে কদরের দিন বাড়ি আসার কথা ছিল। ১ জুলাই শুক্রবার বিকেলে আমার সাথে তার শেষ কথা হয়। পরের দিন জানতে পারি ওই হামলায় তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি আমার স্বামীর লাশ ফেরৎ পেতে অনেক চেষ্টা করেছি। বার বার সরকারের পক্ষ থেকে লাশ ফেরৎ দেয়ার আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাশ না দিয়ে বেওয়ারিশ লাশ বলে তাকে দাফন করা হয়। আমার দুটি মেয়ে এবং ১টি পুত্রসন্তান রয়েছে। এদের এখন কি হবে। ওরা কাকে বাবা বলে ডাকবে। আমি পরের উপর ভর করে কতদিন চলবো। কি করে আমি বাচবো ?


(কেএনআই/এসপি/জুলাই ০১, ২০১৭)