ভ্রমণ ডেস্ক : ভারতের সেভেন সিস্টার্সখ্যাত উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের অন্যতম আকর্ষণীয় রাজ্য মেঘালয়। পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা উত্তর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জি। পাশেই রাজ্যের রাজধানী শিলং। মেঘালয় হচ্ছে মেঘেদের বাড়ি, যা শিল্প-সাহিত্য অনুরাগীদের অনুপ্রেরণার  জায়গা। বেড়ানোর জন্য সাধ্যের মধ্যে এরচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা খুব কমই আছে।

মেঘালয় ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিসমৃদ্ধ জায়গা। সেখানে আষাঢ় কিংবা শ্রাবণের বৃষ্টি উপভোগ করা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। তাই আসছে ঈদে ঘুরে আসতে পারেন শিলং-চেরাপুঞ্জি থেকে। অনেকেই বলে থাকেন, দার্জিলিং যদি হয় রূপের রানী তা হলে শিলং হচ্ছে রাজা। বাংলাদেশের সিলেট তামাবিল থেকে চেরাপুঞ্জি যেতে প্রায় ৬০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। এটুকু পথ পেরুতে সময় লাগবে অন্তত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। শিলং-এর দূরত্ব এরচেয়ে সামান্য বেশি। সময়ও খানিক বেশি লেগে যায়, তবে সীমান্ত পার হয়ে যখন পাহাড়চূড়ার আঁকাবাঁকা পথে চলতে থাকবেন তখন মনে হবে এই দূরত্ব আরও বেশি হলে মন্দ হতো না।

চলার পথে আপনাকে সঙ্গ দেবে চারপাশের অসাধারণ সুন্দর সব পাহাড়! কখনও আপনাকে চারপাশ থেকে ঢেকে দেবে মেঘ। কখনও আবার সরু রাস্তার পাশেই গভীর খাদ। এ এক ভয়ঙ্কর সুন্দর দৃশ্য! এক সময় ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’ নামে পরিচিত শিলং-এ রয়েছে পাইন অরণ্য, জলপ্রপাত এবং পার্বত্য জলধারার সমারোহ। চলুন এবার জেনে নেই সেখানে গিয়ে আপনি আরো কী কী দেখবেন সেই তালিকা।

মওলননোঙ্গ ভিলেজ:

গ্রামটি এশিয়ার পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে পুরস্কারপ্রাপ্ত। লিভিং রুট ব্রিজ, জলপ্রপাত ও কিছু বিস্ময়কর হাঁটার রাস্তাসহ মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক আকর্ষণের জন্য জায়গাটি বিখ্যাত। রাজধানী থেকে এর দূরত্ব ৫৬ কি.মি.। জীবন্ত শেকড়ের তৈরি ‘লিভিং রুট ব্রিজের’ উপর দিয়ে যাওয়ার অনুভূতি যে কোনো মানুষের জন্য স্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে স্মৃতির পাতায় লেখা থাকবে।

উমিয়া লেক:

স্কটল্যান্ডের হ্রদের সঙ্গে এই লেকের তুলনা করা হয়। রাজধানী থেকে বেশ খানিকটা দূরে হলেও ছবির মতো সুন্দর ও প্রশান্ত জায়গায় বসে নির্বিঘ্নে কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে চাইলে এই হ্রদ আপনার জন্য উপযুক্ত জায়গা।

এলিফেন্ট জলপ্রপাত:

বহু বছর পূর্বে এক প্রবল ভূমিকম্পে ধসে পরে একটি পাথর, আকৃতিতে দেখতে হাতির মতো। বিশাল এই পাথরের কাছেই জলপ্রপাতটির অবস্থান। সুতরাং পাথরের নামেই এর নাম। জলপ্রপাতটির তিনটি ধাপ রয়েছে, মাঝের ধাপটি সর্বাধিক আকর্ষণীয়। চাইলেই যে কোনো পর্যটক নিচে নেমে ঝরনাটি দেখতে পারবেন। এ জন্য অবশ্য তাকে অনেকগুলো ধাপ বেয়ে নামতে হবে। জল পরার শব্দ আর বাতাসে তার শীতল স্পর্শ আপনার মন মাতিয়ে দেবে।

শিলং ভিউপয়েন্ট বা পার্ক:

শিলং ভ্রমণে গেলে এখানকার সর্বোচ্চ জায়গাগুলো পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই রোমাঞ্চকর। এখানকার টিলা ও উপত্যকাগুলো বেশ মনোরম আর সর্বক্ষণ যে বাতাস বয় তা কেবলই নির্মল বা বিশুদ্ধ।

গলফ লিঙ্ক ও অয়ার্ডস লেক:

ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত গলফ কোর্সটি ঘুরে দেখার মতো একটি জায়গা, পাইন গাছঘেরা কোর্সটি যেন সবুজ গালিচা বিছিয়ে আপনার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। পাশেই রয়েছে একটি জলপ্রপাত যা স্থানীয়দের যাতায়াতের পথেই পরে। এখান থেকেই পায়ে হাঁটা দূরত্বে রাজহাঁসের সঙ্গে সময় কাটানো এবং বোটিং-এর জন্য চমৎকার একটি জায়গা অয়ার্ডস লেক।


অল সেন্টস চার্চ:

একশ বছরের বেশি পুরনো এই ভবনটি অল সেন্টস ক্যাথিড্রাল নামে পরিচিত। শুধু খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাই নয় পর্যটকরাও এখানে উপস্থিত হন এর ইতিহাস ও স্থাপত্যের সাক্ষী হতে।

লেডি উদ্যান:

ছোট ছোট পুকুরের সমন্বয়ে জাপানি শৈলিতে সাজানো উদ্যানটি যেন এক টুকরো স্বর্গ। উদ্যানের ভেতর চিড়িয়াখানাও রয়েছে। এ ছাড়াও এখানে একটি যাদুঘর আছে, যেখানে পাইথনের চামড়া, চিতাবাঘ, হাতির মাথার খুলি ও বিরল প্রজাতির প্রাণীর ছবি এবং নিদর্শণ সংরক্ষিত রয়েছে।

পুলিশ বাজার:

এটি শিলং-এর প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। এখানকার বেশ কিছু দোকান বর্তমানে প্রতীকি মর্যাদা অর্জন করেছে। যেমন, দিল্লী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এখানকার জিলাপি না খেলে আপনার মেঘালয় ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিক্রেতারা ডামপ্লিং, সেদ্ধ ডিম ও ঠোঙ্গায় মোড়া দারুণ স্বাদের ভুট্টা ভাজা বিক্রি করে। শীতল হাওয়ায় এ সমস্ত স্ন্যাক্স-এর জুড়ি নেই।

যেভাবে যেতে হবে:

শিলং-চেরাপুঞ্জি ভ্রমণের জন্য বিআরটিসি-শ্যামলীর সার্ভিস গ্রহণ করা যেতে পারে। গাড়ি ছাড়ে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে এবং ফিরে আসে সোমবার রাত ১০টায়। সেক্ষেত্রে ভিসা ফিসহ যাতায়াত বাস ভাড়া সাড়ে পাঁচ হাজার জমা দিতে হয়। আর যদি আপনার ভিসা আগেই করা থাকে তাহলে আপনি শুধু বাসের টিকেট কেটেই যেতে পারেন। মনে রাখবেন ট্রাভেল ট্যাক্স ৫০০ টাকা দিতে হবে, যা রওনা দেওয়ার আগে সোনালী ব্যাংক থেকে দিয়ে যাওয়াই ভালো। ঢাকা থেকে সারা রাতে সিলেট, সেখান থেকে বাসে কিংবা সিএনজি অটো রিকশায় তামাবিল। এখানেই ইমিগ্রেশন-কাস্টমস অফিস। সীমান্ত পার হলেই মেঘালয়ের ডাউকি। ইমিগ্রেশন-কাস্টমস-এর আনুষ্ঠানিকতা সেরে ভাড়া করতে হবে ট্যাক্সি। আপনার ভ্রমণের শুরুতে শিলং যাওয়াই উত্তম। শিলং শহর আর তার আশপাশের জায়গাগুলো ঘুরে তারপর সেখান থেকে চেরাপুঞ্জি যাওয়া যেতে পারে। যারা শুধু চেরাপুঞ্জি যেতে চান, তারা ডাউকি থেকেই ট্যাক্সিতে যেতে পারবেন। পাহাড়ের নির্জন হোটেল বা রিসোর্টের আশপাশেই রয়েছে ভ্রমণের বেশ কিছু জায়গা। শিলংয়ে বেড়ানোর জন্য হরেক রকম প্যাকেজ পাওয়া যায়। এ ছাড়া চেরাপুঞ্জি বেড়ানোর প্যাকেজও রয়েছে।

পরিবহন ও অন্যান্য তথ্য:

ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বলে রাখা দরকার, ভাড়া করা ট্যাক্সি শিলং ও চেরাপুঞ্জিতে বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো বাহন। তবে বড় দল হলে শিলং থেকে বাস ভাড়া করেও চেরাপুঞ্জি যাওয়া যাবে। তবে সীমান্ত পার হওয়ার পর বেনাপোল কিংবা চেংড়াবান্ধার মতো মুদ্রা বিনিময়ের সুযোগ কিন্তু সীমিত। এমনকি শিলংয়ের মতো শহরেও ডলার ভাঙানো সহজ নয়, টাকা ভাঙানো প্রায় অসম্ভব। তাই প্রাথমিক ঘোরাফেরার জন্য যতদূর সম্ভব সীমান্ত এলাকাতেই বেশ কিছু ডলার ভাঙিয়ে নিন। এরপর শিলংয়ে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়াতে ডলার ভাঙাতে পারবেন। শিলং-এ সারাবছর মনোরম আবহাওয়া মেলে। তবে মার্চ ও জুন মাস বেড়াতে যাওয়ার আদর্শ সময়। গ্রীষ্মে হালকা উলের পোশাক ও শীতে ভারি গরম জামা কাপড়ের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বৃষ্টি এ অঞ্চলে যখন-তখন হতে পারে। সুতরাং, ছাতা আর রেইন কোট ও রাবারের জুতা অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে। বেড়ানো শেষে কেনাকাটা করতে হলে শিলং-এর পুলিশ বাজারের দোকানগুলো ভালো। শহরে অত্যাধুনিক শপিং মলও রয়েছে।

থাকার জন্য সামর্থের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মানের হোটেল। সাশ্রয়ী পর্যটকদের জন্য পাইথন সুইটস হোটেল, হোটেল নাইট ইন এবং শিলং ক্লাব গেস্ট হাউস অধিক পরিচিত। এ ছাড়াও হোটেল সেন্টার পয়েন্ট এবং হোটেল আলপাইন কন্টিনেন্টাল হল শিলং-এর মাঝারি মানের মধ্যে প্রসিদ্ধ হোটেল। হোটেল পোলো টাওয়ার্স এখানকার একমাত্র চার তারকা হোটেল। চেরাপুঞ্জি হলিডে রিসোর্টও থাকার জন্য ভালো জায়গা। তবে সেখানে থাকার মতো বেশি হোটেল এখনও গড়ে ওঠেনি, ফলে আগে থেকে হোটেল বুকিং নিশ্চিত করতে হবে। শিলং-এ ভালো মানের হোটেলের ভাড়া দিনপ্রতি ১৫০০-২০০০ রুপি।


(ওএস/এসপি/জুলাই ০২, ২০১৭)