কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি : ৭ জুলাই ২০১৬। সকাল পৌনে ৯টা। ঈদের জামাত শুরু হবে ১০টায়। এরই মাঝে শোলাকিয়া ময়দান ভরে যায় কানায় কানায়। বিভিন্ন রাস্তায় তখনও শোলাকিয়াগামী হাজারও মুসল্লির ঢল। ঠিক তখনই ঈদগাহের পাশে আজিমউদ্দিন হাইস্কুল সংলগ্ন এলাকায় পুলিশের একটি নিরাপত্তা চৌকিতে অতর্কিত হামলা চালায় সশস্ত্র জঙ্গিরা। ঈদের খুশির দিনে জঙ্গিদের বোমা আর গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে দেশের বৃহত্তম ঈদগাহ শোলাকিয়া ময়দানের আশপাশ।

হামলায় নিহত হন পুলিশের দুই কনস্টেবল আনসারুল হক ও জহিরুল ইসলাম। হামলার পর পুলিশের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলা বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাস্থলে নিহত হয় আবির রহমান নামে এক জঙ্গি। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন শোলাকিয়া এলাকার গৃহবধূ ঝর্ণা ভৌমিক।

জানা গেছে, কথিত ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে পরিকল্পিতভাবে দেশে একের পর এক জঙ্গি হামলা চালায় নব্য জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গিরা। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করা। প্রাথমিকভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে জঙ্গিরা। সরকারকে তটস্থ রাখতে শুরু করে একের পর এক গুপ্ত হামলা। সবশেষ প্রশিক্ষিত আত্মঘাতী জঙ্গি, অস্ত্র ও টাকার মজুদ গড়ে তোলে বড় ধরনের ‘অপারেশনে’ নামে।

পুলিশের সূত্র মতে, শোলাকিয়া হামলায় প্রশিক্ষিত পাঁচ জঙ্গি মাঠে থাকলেও সরাসরি অপারেশনে অংশ নেয় দুজন। ঈদের দিন সকালে অপারেশনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও দিকনির্দেশনার পর দুই জঙ্গিকে মাঠের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে কিশোরগঞ্জ ছাড়ে তিন জঙ্গি।

শোলাকিয়া হামলার মূল পরিকল্পনাকারী রাজীব গান্ধী ঢাকার হলি আর্টিসানে হামলায় সরাসরি অংশ নিলেও শোলাকিয়া হামলায় সে ঘটনাস্থলে ছিল না। শোলাকিয়া হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া আসামির মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে পাঁচজনই নিহত হয়েছে।

ঘটনাক্রম

জঙ্গি হামলার পর গত বছরের ১০ জুলাই কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা করা হয়। পাকুন্দিয়া থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সামসুদ্দীন বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় (মামলা নং-১৪) হামলার সময় আহত অবস্থায় আটক জঙ্গি সাইফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলাম ওরফে ডন ও কিশোরগঞ্জের পশ্চিম মনিপুরী গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে জাহিদুল হক তানিমসহ আরও কিছু অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীকে আসামি করা হয়। পরিদর্শক মুর্শেদ জামানকে চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।

হামলার সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় কুমিল্লার দেবিদ্বারের ত্রিবিদ্যা গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে ও ঢাকার নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জঙ্গি আবির রহমান। আহত ডনকে ওই দিনই র্যাব হেফাজতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে গত বছরের ৪ আগস্ট ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে কিশোরগঞ্জ আসার পথে রাত ৯টার দিকে কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ সড়কের নান্দাইল উপজেলার বরইগ্রাম এলাকায় ডনকে ছিনিয়ে নিতে র্যাবের ওপর হামলা করে সন্ত্রাসীরা। এ সময়ে র্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ারে শফিউল ইসলাম ডনসহ দুই যুবক নিহত হয়।

ডনের কাছেই মিলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

এদিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শফিউল ইসলামের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এরপরই দেশের বিভিন্নস্থানে জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলে। গত বছরের ১৪ আগস্ট গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জের পান্থাপাড়া গ্রামের মৃত হাকিম উদ্দিন আকন্দের ছেলে মো. আনোয়ার হোসেনকে (৪৫) শোলাকিয়া হামলা মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়।

২০১৬ সালের ২৩ জুলাই গোবিন্দগঞ্জ থানা পুলিশ আনোয়ার হোসেনকে ৫৪ ধারায় আটক করলেও পরে সন্ত্রাস দমন আইনের একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। জঙ্গি শফিউল ইসলাম ওরফে ডন, অভিযানের সময় নিহত আবির রহমানসহ হলি আর্টিসান ও শোলাকিয়া হামলায় জড়িত শীর্ষ জঙ্গিদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতেন আনোয়ার হেসেন। বর্তমানে তিনি কশোরগঞ্জ কারাগারে আছেন। আর রাজীব গান্ধীকে গত ২৫ মে কিশোরগঞ্জ আদালতে হাজির করে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় রাজীব গান্ধী। জাহাঙ্গির আলম ওরফে রাজীব গান্ধী গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাঘাটা পশ্চিম রাঘবপুর গ্রামের মৃত মাওলানা উসমান গনি মন্ডলের ছেলে।

সরকার পতনের মিশন

রাজীব গান্ধী ঢাকার হলি আর্টিসান ও শোলাকিয়া হামলায় অংশ নেয়া প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের নিয়োগ দেয়। ঢাকায় একটি অভিজাত এলাকায় শীর্ষ জঙ্গিরা অপারেশন চালানোর আগে দু’দফা বৈঠক করে। রাজীব গান্ধী ছাড়াও তানিম চৌধুরী, মারজান, সারোয়ার জাহান মানিক, মেজর জাহিদসহ অন্য জঙ্গিরা সভায় অংশ নেয়। জঙ্গিরা দেশে দুটি বড় ধরনের হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের বিশ্বাস ছিল এতে করে সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। ঢাকার হলি আর্টিসান ও শোলাকিয়ায় হামলার জন্য খায়রুল ইসলাম পায়েল ওরফে বাধন, শরিফুল ইসলাম ওরফে ডন, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিকাশ ও রুহান ইমতিয়াজ স্বপন নামে চার নব্য জেএমবি সদস্যকে নিয়োগ দেয় রাজীব গান্ধী।

ডেটলাইন শোলাকিয়া

গত বছর ঈদুল ফিতরের আগে ২৭ রমজান তামিম চৌধুরী, মেজর জাহিদ, আকাশ, ডন ও আবির রহমান কিশোরগঞ্জে আসে। আকাশ কলেজ ছাত্র পরিচয়ে শহরের নীলগঞ্জ রোডে পরশমণি নামে একটি বাসা ভাড়া নেয়। ৭ জুলাই অস্ত্র, বোমা ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ একটি অটোরিশসায় করে পাঁচ জঙ্গি শোলাকিয়া মাঠের অদূরে আসে। তারপর অপারেশনের জন্য ডন ও আবিরকে অটো থেকে নামিয়ে দিয়ে তারা ফিরে যায়। নির্দেশ অনুযায়ী ওই দুই জঙ্গি শোলাকিয়া ঈদগাহের কাছে হামলা চালায়।

এ ৫ জঙ্গি দেশে ২৪টি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার আসামি। তবে রাজীব গান্ধী ছাড়া বাকি পাঁচজনই এখন আর বেঁচে নেই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, তামিম চৌধুরী নারায়ণগঞ্জে, মেজর জাহিদ রুপগঞ্জে, আকাশ গাজীপুরের পাতার টেকে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়েছেন। এর আগে ঘটনাস্থলে আবির রহমান নিহত হয়। আর শফিউল ইসলাম ওরফে ডন র্যাবের সঙ্গে ক্রসফায়ারে মারা যায় ।

মামলার সর্বশেষ অবস্থা

বর্তমানে এ মামলায় কারাগারে আছে জাহিদুল হক তানিম, রাজীব গান্ধী ও মো. আনোয়ার হোসেন। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় এখনও আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়নি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মুর্শেদ জামান জানান, এ মামলার মোটিভ উদ্ধার করা হয়েছে। জড়িতদের অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে অস্ত্র ও অর্থের জোগানদাতা, নেপথ্য মদদদাতা, তথ্য পাচারকারীসহ অন্যদের শনাক্ত ও ধরতে কাজ করছে পুলিশ।

কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন খান জানান, এটি একটি বড় মামলা। এর সঙ্গে আরও অনেক ঘটনা জড়িত আছে। সঠিক পথেই মামলার তদন্ত এগুচ্ছে। হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে। সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

(ওএস/এসপি/জুলাই ০৭, ২০১৭)