আরিফ ইসলাম


বর্তমান সরকার ঘোষিত নির্বাচনী ইস্তেহার অনুযাযী ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে বাধ সাধলো বঙ্গবন্ধুর নিজ জন্মস্থান ও তার বেড়ে ওঠার জেলা বৃহত্তর ফরিদপুর। প্রধান মন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও তার আইটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে জনৈক ঠিকাদার শেখ মাসুম।তার ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি এবং গাফিলতির কারনে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার ১১ উপজেলা অপটিক্যাল ফাইবারের আওতায় এখনো আসেনি। দীর্ঘ দিনেও কাজ শেষ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। ফলে গোটা বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ জেলা অপটিক্যাল ফাইবারের আওতায় আসলেও বাদ পড়ে রয়েছে প্রধান মন্ত্রীর নিজ জেলা ফরিদপুর ও পাশের জেলা শরীয়তপুর।

ব্যাপক অনুসন্ধানে ও প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন লিঃ স্কাই লিমিট এন্টার প্রাইজ জেভি দরপত্রের মাধ্যমে ফরিদপুরের ৬ টি উপজেলা সহ ঢাকা বিভাগের মোট ৬৭ টি উপজেলার অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন সহ সংযোগের পুরো কাজের আবেদন করে। ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারী কাজের চুক্তিপত্র গ্রহন করে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তির পর ৬ মাসের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করার কথা থাকলেও নির্ধারিত ২০১৫ সালের ২০ জুলাইয়ের মধ্যে ফরিদপুর জেলার ৬টি উপজেলা এবং শরীয়তপুরের ৫টি উপজেলার কাজ সমাপ্ত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। একাধিকবার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করা সত্বেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তার কোন তোয়াক্কা না করে নির্ধারিত সময়ের পর দীর্ঘ ২ বছর পার হয়ে গেলেও উল্লেখিত উপজেলাগুলোর কাজ আজও সম্পন্ন করতে পারেনি। ফলে ফরিদপুর জেলা ও শরীয়তপুর জেলার উপজেলাগুলো অপটিক্যাল ফাইবারের আওতাধীন হয়নি। যার কারনে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পুরনে সম্পুর্ন ব্যর্থ হয়েছে বি টি সি এল।

সারা দেশের ৭টি বিভাগের মোট ২ শ’ ৯০ টি উপজেলার প্রতিটি ইিউনিয়নকে অপটিক্যাল ফাইবারের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহন করে সরকার এর মধ্যে ৬৭ টি উপজেলার কাজ দেওয়া হয় ন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন এবং স্কাই লিমিট এন্টার প্রাইজকে। পরবর্তিতে আরো ৪ টি উপজেলা সহ মোট ৭১ টি উপজেলার কাজ দেওয়া হয় এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে। যদিও অভিযোগ রয়েছে বিনা টেন্ডারে ৪ টি উপজেলার কাজ দেওয়া হয়েছে উক্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে।

খোজ নিয়ে জানা যায়, বিটিসি এল এর কতিপয় উর্ধতন কর্মকর্তারা সরকারী চাকরি করেও এই ঠিকাদীর প্রতিষ্ঠানের অলিখিত পার্টনারশিপ গ্রহন করে।যার ফলে অদ্যবধি এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রহস্যজনক কারনে কোন প্রকার শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহন করেনি বিটিসিএল কতৃপক্ষ। এই উপজেলা গুলোর কাজ সমাপ্ত না করায় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ভিশন ২১ আলোর মুখ দেখলো না। এ্কইসাথে অপটিক্যাল ফাইবার এর আওতাধীন না হওয়ায় ফরিদপুর এবং শরিয়তপুর জেলাবাসীর মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হযেছে।তবে প্রধানমন্ত্রীর নলেজে বিষয়টি নেই বলে ফরিদপুরবাসী ধারনা করেছে।

এদিকে যেসব কাজ শেষ করেছে এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি সেসব উপজেলার কাজও অত্যন্ত নিন্মমানের ফলে সেসব এলাকার মানুষের মাঝেও রয়েছে চরম ক্ষোভ। ভুক্তভোগী এলাকাবাসী নিন্ম মানের কাজের জন্য এবং ফরিদপুর ও শরীয়তপুর জেলার বিক্ষুব্দ মানুষেরা এই চরম দূর্নীতিবাজ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজ পথে আন্দোলন সংগ্রামের প্রস্ততি নিচ্ছে বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ফরিদপুর এবং শরীয়তপুর জেলার মোট ১১ টি উপজেলার অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপনের কাজ নতুন করে শুরু না করলে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে বিটিসিএল এর অফিস ঘেড়াও কর্মসুচি পালনেরও ঘোষনা দিয়েছে ফরিদপুর ও শরীয়তপুর জেলার সচেতন মানুষেরা।

এব্যাপারে বি টি সি এল এর এমডি মাহফুজ উদ্দীন আহমেদ জানান, ৬ মাসের মধ্যে কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেনি। এব্যাপারে তাদেরকে অসংখ্যবার চিঠিও দেওয়া হয়েছে।তবে আগামী পাচ মাস অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যেই অধিকাংশ এলাকার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। অধিকাংশ এলাকায় শেষ হওয়া কাজের মান অত্যন্ত নিন্মমানের হয়েছে বিষয়টি উল্লেখ করলে এম ডি বলেন, যদি কোন ঠিকাদার কাজের ক্ষেত্রে সিডিউল অনুযায়ী কাজ করে না থাকে এবং নিন্মমানের কাজ হয়ে থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

এ ব্যাপারে উপজেলা অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের উপ প্রকল্প পরিচালক মোঃ আমিনুর রহমান বলেন, ২৯০টি উপজেলার মধ্যে ২শ’ ৪০ টি উপজেলার কাজ ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছ বাকী উপজেলাগুলোর কাজও দ্রুত গতিতে শেষ করা হচ্ছে। ফরিদপুর এবং শরীয়তপুর জেলার ১১ টি উপজেলায় কাজ শুরু করা হয়েছে বলে তিনি জানান । তবে স্কাই লিমিট এন্টার প্রাইজ এর নতুন প্রজেক্ট ম্যানেজার সৈয়দ রেহান আহমেদ বলেন, ফরিদপুর এবং শরীয়তপুর জেলার ১১ টি উপজেলার অপটিক্যাল ফাইবারের কাজ আগামী শনিবার শুরু করা হবে।

কেন ৬ মাসের কাজ দীর্ঘ ২ বছরেও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এবং বিটিসিএল ই বা কি কারনে ৬ মাসের মধ্যে পুরো কাজ বুঝে নিতে পারে নি এই প্রশ্নের জবাবে উপজেলা অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের উপ প্রকল্প পরিচালক মোঃ আমিনুর রহমান বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকবার এব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে কিন্তু তারা সেই চিঠির কোন গুরুত্ব দেয়নি এমনকি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির মালিককে স্বশরীরে বি টি সি এল এর প্রধান কার্যালয়ে ডেকে এনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে বলা হলেও তারা সেটি করেনি।

এদিকে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান এর ঠিকাদার প্রায় ২২ টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কাজের সাব কন্টাক্ট দেয়। যে সমস্ত এলকার কাজ সাব কন্টাক্টররা শতভাগ শেষ করেছে সেই সমস্ত ঠিকাদারদেরকে তাদের পাওনা পরিশোধ না করে ৫০ লাখ টাকার জায়গায় মাত্র ৮ লাখ টাকা পরিশোধ করে।ঠিক একই ধরনের আচরন বাকী সাব কন্টাক্টর দের সাথে করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিক্ষুব্দ ঠিকাদারেরা এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে গত বছরের কোরবানীর ঈদের ঠিক চারদিন আগে ঢাকার পল্টন লাইনে অবস্থিত স্কাই লিমিট এন্টার প্রাইজ এর প্রধান কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এসময় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এর ভাগ্নে প্রজেক্ট ম্যানেজার সৈয়দ রেহান আহমেদ এর মাধ্যমে সাবকন্টাক্টরদেরকে পাওনা পরিশোধের কথা বলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাব কন্টাক্টরদেওরকে শান্ত করে। যদিও পরবির্তিতে উল্লেখযোগ্য পরিমানের অর্থ কোন সাবকন্টাক্টরকে দেওয়া হয়নি বলে তারা অভিযোগ করেছে।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির প্রথম এক বছর প্রজেক্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব পালনকারী মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, সিডিউলে উল্লেখিত কাজ কোন জায়গায়ই সঠিকভাবে করা হয়নি। গোজামিল দিয়ে এবং নিন্মমানের সামগ্রি দিয়ে অপটিক্যাল ফাইবারের কাজ শেষ করেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি যদিও এক বছর দায়িত্ব পালন করার পর সৈয়দ রায়হান এসে তাকে সরিয়ে দিয়ে প্রজেক্ট ম্যাজারের দায়িত্ব নিয়ে সাবকন্টাক্টরদের সাথে মাস্তানির মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে এবং কোন সাব কন্টাক্টরকেই তাদের পাওনা সঠিকভাবে পরিশোধ করেনি।

কে এই সৈয়দ রেহান আহমেদ?
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাজিন ব্রাদার পরিচয় দিয়ে সৈয়দ রেহান আহমেদ এই প্রতিবেদককে বলেন, তিনি একজন সফ্ট ওয়ার ইঞ্জিনিয়ার এবং টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের সাবেক এক অতিরিক্ত সচিব এর ভাগ্নে।গত ১০ মাস আগে জটিলতা সৃষ্টি হলে তিনি এগিয়ে আসেন এবং তার কাজিনকে সহযোগিতা করেন একই সাথে প্রজেক্ট ম্যানেজারের দায়িত্বও গ্রহন করেন। অধিকাংশ কাজের শতভাগ বিল বি টি সি এল থেকে তুলে নিলেও কেন সাব কন্টাক্টরদের পাওনা পরিশোধ করেন নি? এই প্রশ্নের জবাবে রেহান বলেন,যাদের কাজের মান ভালো হয়নি তাদের পাওনা আমরা পরিশোধ করিনি এবং যে যেটুকু কাজ সঠিকভাবে শেষ করেছে আমরা তাদেরকে সেটুকু পাওনাই পরিশোধ করেছি।

এই প্রকল্পে বিটিসি এল এর প্রজেক্ট ডিরেক্টর মাইনু্িদ্দন আহমেদ এর মুঠো ফোনে যার নম্বর ০১৫৫০-১৫১০৮১ এ যোগাযোগ করলে এবং এ ব্যাপারে তার বক্তব্য চাইলে তিনি ভুল নম্বরে এবং ভুল ব্যাক্তির কাছে ফোন এসছে এবং তিনি প্রজেক্ট ডিরেক্টরও নন বলে দাবী করেন যদিও বিটিসিএলএর এমডি মাহফুজ উদ্দিন এই নম্বরটি প্রজেক্ট ডিরেক্টর বলে নিশ্চিত করেছেন।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য :
স্কাই লিমিট এন্টার প্রাইজ এর স্বত্বাধিকারী শেখ মাসুম জানান, বিভিন্ন সমস্যার কারনে তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারেন নি। এছাড়াও প্রয়োজনীয় পন্য সময়মত বি টি সি এল তাদেরকে সরবরাহ করতে না পারায় তাদের কাজে বিলম্ব হয়েছে। সাব কন্টাক্টরদের তার অফিসে তালা মারার বিষয়টি স্বিকার করে মাসুম বলেন, সব সাবকন্টাক্টরকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি নিন্ম মানের কাজের বিষয়টিও পুরোপুরি অস্বীকার করেন।

(এআই/এএস/জুলাই ০৯, ২০১৭)