প্রবীর বিকাশ সরকার  


১৯১৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম জাপান ভ্রমণ করেন। ২০১৬ সাল ছিল সেই ভ্রমণের শতবর্ষপূর্তি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা পরিলক্ষিত হয়নি জাপান কিংবা ভারতে। বলা যায় একপ্রকার নীরবেই অতিবাহিত হয়ে গেছে বছরটি।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপান ভ্রমণ তাঁর জীবনেই শুধু নয়, ভারত তথা এশিয়ার ক্ষেত্রেও এক ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গভীর তাৎপর্যপূর্ণও বটে। কেন তাৎপর্যপূর্ণ? এই বিষয়েও আদৌ আলোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আলোচনা না হওয়ার প্রধান কারণ ‘রবীন্দ্র-জাপান সম্পর্কে’র ইতিহাসটা এখনো অজ্ঞাত বলে প্রতীয়মান হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেছিলেন এবং জাপানদ্বারা প্রভূত প্রভাবিত হয়েছিলেন সে সম্পর্কে বাঙালি এবং ভারতবাসী অজ্ঞাতপ্রায় বললে অতিরিক্ত বলা হয় না। অন্যদিকে, অনেক জাপানি যে তাঁর সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত, শিক্ষাভাবনা, দর্শন, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাবাদ, প্রকৃতিচিন্তা, শিশুভাবনা, ধর্মচিন্তা, বিশ্বজনীনতাদ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তারও ইতিহাস প্রায় অজ্ঞাত। বলা যেতেই পারে যে, তাঁকে নিয়ে এত বিপুল ভাবনা ও মাতামাতি জাপানিরা যেভাবে করেছেন বিগত শতবর্ষ ধরে এমনটি বিশ্বের আর কোনো জাতি করেছে বলে খবর পাচ্ছি না। এর কী কারণ সেটা গবেষণার বিষয় বলেই মনে করি।

রবীন্দ্রনাথের প্রথম ভ্রমণেই সুদূরপ্রসারী দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে যা ‘রবীন্দ্র-জাপান সম্পর্ক’ এবং ‘ভারত-জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে’র ভিত রচনা করে বলে আমার একান্ত বিশ্বাস। প্রথম ঘটনা, ওয়াদা তোমিকো নামক এক উচ্চশিক্ষার্থী ছাত্রীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। দ্বিতীয় ঘটনা, ১৯১৫ সালে পিএন ঠাকুর (প্রিয়নাথ ঠাকুর) ছদ্মনাম ধারণ করে ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জাপানে পালিয়ে এসে আশ্রয়গ্রহণ।

রবীন্দ্রনাথ এবং কোওরা তোমি সম্পর্ক:
১৮৯৬ সালে জন্ম ওয়াদা তোমিকো ১৯১৬ সাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত গুরুদেবকে বিস্মৃত হননি। পরম শ্রদ্ধাভাজন গুরুদেবের সঙ্গে তাঁর সর্বমোট ছয়বার সাক্ষাৎ ঘটেছিল। চারবার জাপানে, একবার করে আমেরিকা ও ভারতে তথা শান্তিনিকেতনে। জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কাতক ডিগ্রি নিয়ে আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এবং ‘Experimental Study of Hunger in its Relation to Activities’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি ১৯২২ সালে। পরবর্তীকালে বিবাহজনিত কারণে তাঁর নাম বদলে হয় কোওরা তোমিকো। তাঁর স্বামীও ছিলেন খ্যাতিমান মনঃচিকিৎসক এবং মনোব্যাধিবিষয়ক লেখক ডাঃ কোওরা তাকেহিসা (১৮৯৯-১৯৯৬)। তবে কোওরা তোমি নামে তিনি জাপানে সুপরিচিত।

জাপানের প্রথম মনস্তত্ত্ববিদ---ইংরেজিতে পারদর্শী ড.কোওরা তোমি ছিলেন জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা, আন্তর্জাতিক নারীমুক্তি আন্দোলন, বিশ্বশান্তিবাদী আন্দোলনের প্রথম সারির নেত্রী এবং দুবার জাতীয় সংসদ ‘ডায়েটে’র নির্বাচিত সদস্যা। মূলত ‘মিনশুতোও’ বা ‘ডেমোক্রেটিক পার্টি’র সদস্য হলেও চিন্তা ও চেতনায় তিনি ছিলেন আমতৃ্যু সাম্যবাদী, শান্তিবাদী এবং প্রাচ্যাদর্শী। দেশ, জাতি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ‘কুননিতোও জুইহোওশোও’ বা ‘Orders of the Sacred Treasure’ -পদকে ভূষিত হন। তা ছাড়া প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ‘তাইসেইয়োকু সানকাই’ বা ‘Imperial Rule Assistance Association’ (১৯৪০-৪৫) এর মহিলাবিষয়ক সম্মানীত সদস্য ছিলেন। এহেন বড়মাপের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক জাপান-বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক ব্যতিক্রম আলোকোদ্দীপক অধ্যায়। দোভাষী থেকে ক্রমে ক্রমে রবীন্দ্ররচনার অনুবাদক এবং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখিত গ্রন্থের রচয়িতা হয়ে উঠেছিলেন শ্রীমতী তোমি। রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর রচনা নিয়ে অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও স্মৃতিকথা লিখে রেখে গেছেন জীবনভর। এর মধ্যে দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হচ্ছে, ‘শিনৎসুকি.রাবিনদোরোনা-তো তাগো-রো’ বা ‘নতুন চাঁদ.রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ (আপোলোনশা/ ১৯৬২) এবং ‘শি তো জিনসে তাগো-রো’ বা ‘কবিতা ও জীবন ঠাকুর’ (আপলোনশা / ১৯৬৭)। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর আর কোনো বিদেশি নারীভক্ত গবেষণা ও গ্রন্থরচনা করেছেন বলে আমার জানা নেই। গুরুদেবের প্রতি তিনি এতই অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাঁর নতুন বাড়ির নামও রেখেছিলেন ‘শান্তিনিকেতন’ বলে জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমার ভাষ্য থেকে জানা যায়। তাঁর রবীন্দ্রপ্রীতি এতই গভীর ছিল এ প্রসঙ্গে স্বনামধন্য লেখিকা সুগে ইয়াসুকো ১৯৮৩ সালে যা লিখেছেন তা প্রণিধানযোগ্য: “(কোওরা তোমি) জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালীন আকস্মিক সাক্ষাতপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাভাবনার দ্বারা বড় রকমে বাম-ডান দিকে আন্দোলিত হয়েছেন।”........“বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে প্রথম (রবীন্দ্রনাথের) ভাষণ শোনা এবং (সেই বছরের) গ্রীষ্মকালে (বিশ্ববিদ্যালয়ের) কারুইযাওয়া শিক্ষাকেন্দ্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সময় কাটানো (কোওরা তোমি) হৃদয়স্পন্দিত গভীর অনুভূতি অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের উচ্চারিত প্রতিটি কথা মনযোগের সঙ্গে শুনে লিপিবদ্ধ করে নিতেন। আশ্চর্য হওয়ার মতো যে, ৮৭ বছর বয়সী হয়েও এখনো সেই সময়কার স্মৃতিচিত্র উজ্জ্বলভাবে স্থিত: (যেমন) রবীন্দ্রনাথ সেখানে ছাত্রীদেরকে শোনানো তাঁর কবিতার কয়েকটি আবৃত্তি করে দেখান। সম্ভবত তিনি সেইসব কবিতা যা রবীন্দ্রনাথের নিষ্কলুষ আত্মা বলা উচিত তার দ্বারা প্রকম্পিত হয়েছেন। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অপরিমেয় ভক্তিজ্ঞান আমৃত্যু অপরিবর্তিত ছিল এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব, চিন্তা এবং রচনাকে অনবরত জাপানে পরিচিত করে গেছেন। তাঁর (কোওরা তোমি) জীবনবৃত্তান্তে লিখেছেন যতবার রবীন্দ্রনাথ জাপানে এসেছেন ততবার তাঁর দোভাষী হিসেবে অনুষঙ্গী হয়েছেন, ভারতেও গিয়েছেন। এবং তাই তাঁর এখনকার অবস্থান ‘নিহোন তাগো-রো কাই’ (জাপান টেগোর সংস্থা) এর সভানেত্রী। সেই পর্যন্ত তাঁকে প্রভাবিতকারী রবীন্দ্রনাথের চিন্তাভাবনাকে একটি বাক্যে ব্যাখ্যা করা কঠিন।”........“রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্যের জাতীয়তাবাদের কেন্দ্রে যুদ্ধ এবং আগ্রাসী মনোভাব স্থিতধী বলে নির্দেশ করেছেন, এবং সেটাকে অনুসরণকৃত জাপান তার প্রকৃতি ও সৌন্দর্যকে এপর্যন্ত পরিচর্যা করে এসে (এখন) নিজের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিকে নিজেরাই ধ্বংস করে চলেছে বলে কঠোর সাবধানতা উচ্চারণ করেছেন। সেটা (কোওরা তোমি) ক্রমাগত জাপানি ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে জাপানিদেরকে কাছে উপস্থাপন করে গেছেন। শ্রীমতী তোমি রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছিলেন। (রবীন্দ্রনাথ) তাঁকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে জীবনধারা অনুসরণকল্পে নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওপর দাঁড়িয়ে নিজস্ব সভ্যতা নির্মাণে প্রাচ্যদৃষ্টি দান করে গেছেন।”১ (অনুবাদ)। এ ছাড়াও মাদাম কোওরা তোমির কন্যা প্রসিদ্ধ কবি কোওরা রুমিকোর ভাষ্য থেকেও জানা যায় যে, “(মা) বাড়িতে ভারত প্রসঙ্গে বেশিকিছু না বললেও সবসময় রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম এবং উপহার হিসেবে ভারতীয় কাপড় কিনে আনতেন। এভাবে কখন যেন (আমাদেরকে) আন্তর্জাতিক মনোভাবে পরিপুষ্ট করে গেছেন।” ২ (অনুবাদ)।

অন্যদিকে, গুরুদেব রবীন্দ্রনাথও কোওরা তোমির প্রতিভা এবং কর্মযজ্ঞের গুণে এতই বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে, ১৯২৯ সালের ২৭ মার্চ তারিখে তাঁকে উদ্দেশ করে লিখে দিয়েছিলেন দুছত্রের একটি কবিতা:
It is not a bower made white with the bunches of Jasmine
It is waves swinging with the turbulent foam.

১৯৩৫ সালে কবিগুরুর টানে ভারত সফরকালে শান্তিনিকেতন পর্র্যন্ত চরণ সম্প্রসারিত করে গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন। গ্রহণ করেছিলেন ক্ষণকালীন আতিথ্য। গুরু ও শিষ্যা দুজনেই যে দীর্ঘদিন পর মিলিত হতে পেরে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন তা বলাই বাহুল্য।

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিপুল ধ্বংস ও রক্তস্নানের পর আমূল বদলে গেছে পৃথিবী এবং মানবসমাজ। ততদিনে কবিও চলে গেছেন ইহলোক ত্যাগ করে একবুক অশান্তি আর অতৃপ্তি নিয়ে---সভ্যতার সঙ্কট পরিদৃষ্ট হয়ে। পরাধীন ভারতের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা না দেখেই। মাদাম কোওরা তোমি বিশ্বের এই পরিবর্তন স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করে ব্যথিত হয়েছেন, হিংসা-প্রতিহিংসার অনলে এশিয়াকে পুড়তে দেখেছেন। সন্দেহ নেই, ১৯৪১-৪৫ পর্যন্ত দীর্ঘ যুদ্ধের সময় গুরুদেবকে স্মরণ করে কেটেছে তাঁর নিরানন্দ সময়। কবিগুরুর মৃত্যু সংবাদ তো যুদ্ধের আগেই জেনেছেন পত্রিকান্তরে। সেই আঘাত সইতে না সইতেই মাস চারেক পর ডিসেম্বর মাসে বেঁধে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

১৯৪৭ সালে গুরুদেবের আরাধ্য স্বাধীনতা ভারত অর্জন করলো। অন্যান্য বহু রবীন্দ্রভক্তের মতো তিনিও আনন্দিত হয়েছিলেন। বছর দুয়েক পর এক অপ্রত্যাশিত সুযোগ এলো তাঁর কাছে। গুরুদেবের জন্মভূমি স্বাধীন ভারতে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে প্রধান মন্ত্রী নেহরুর আহবানে অনুষ্ঠিত হলো ‘বিশ্ব শান্তি সম্মেলন’ আর তাতে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণের সময় শান্তিনিকেতনে পুনরায় পদার্পণ করে গুরুদেবকে গভীর ভারাক্রান্ত মনে স্মরণ করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে গঠিত ‘টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন’র কার্যনির্বাহী পরিষদের অন্যতম পরিচালক হিসেবে ভূমিকা রাখেন। কলকাতায় কবিগুরুর শততম জন্মবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে আবার ভারতে গিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের স্থানিক স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য কবিগুরুর ১২০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি আবক্ষ স্মারক ভাস্কর্য স্থাপন করেন নাগানো-প্রিফেকচারের কারুইযাওয়া শহরের উপকণ্ঠে আসামা পর্বতের সবুজ পাদদেশে ১৯৮১ সালে। তখন তাঁর বয়স ৮৫। ‘জিনরুই ফুছেন’ বা ‘যুদ্ধহীন মানবজাতি’ নামকৃত এটাই জাপানে রবীন্দ্রনাথের প্রথম ভাস্কর্য। এ প্রসঙ্গে তাঁর অনুভূতি জীবনীতে লিখেছেন এভাবে: “....জাপান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা মিলে চাঁদা তুলে সেই চাঁদার অর্থে আমি টেগোর সংস্থার সভানেত্রী হিসেবে এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করেছি। এই ভাস্কর্যের বুকে ‘জিনরুই ফুছেন’ বর্ণমালা খোদিত আছে। রবীন্দ্রনাথ জীবনভর অহিংস-পৃথিবীর জন্য আবেদন করে গেছেন। এখন আমাদের উচিত তাঁর কথাকে আঁকড়ে ধরা। মানুষ হত্যা করে অর্থলাভ করা, ক্ষমতা অর্জনের চেষ্টারত অগণিত লোককে রোধ করা সহজ নয়। অর্থলিপ্সা, ক্ষমতার লোভ মনুষ্যত্বের অভ্যন্তরে গভীর শেকড় ছড়ানো এক অশুভশক্তি। এই শক্তি কে বা কারা সেটা বলার চেয়ে সমস্ত মানবজাতি মিলে এই অশুভশক্তিকে রোধ না করলে নয়। অহিংসার লড়াই রাজনীতির ক্ষেত্রে, শিল্পকলা বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে---যেক্ষেত্রেই হোক না কেন জীবন বাজি ধরেই লড়াই করতে হয়। এই লড়াই সমস্ত মানবজাতির লড়াই।” ৩ (অনুবাদ)।

কবিগুরুর স্মারক-ভাস্কর্য স্থাপন করে থেমে থাকেননি তিনি, তাঁর আশীর্বাদধন্য রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা গঠিত ‘জাপান টেগোর সমিতি’র (পরবর্তীকালে ‘ভারত-জাপান টেগোর সংস্থা’) সঙ্গেও জড়িত হন ১৯৭১ সালে। মাদাম কোওরা তোমিসহ আরও একাধিক প্রবীণ রবীন্দ্রভক্তের আগ্রহ ও সহযোগিতায় অধ্যাপক আজুমা রবীন্দ্রনাথের ‘স্বপ্ন’ ‘জাপান ভবন’ তথা ‘নিপ্পন ভবনে’র কাজ সুসম্পাদন করেন ১৯৯৪ সালে শান্তিনিকেতনের শ্রীনিকেতনে। অবশ্য আগের বছর ১৯৯৩ সালে এই মহীয়সী রবীন্দ্রভক্তের জীবনাবসান ঘটে। যদি বেঁচে থাকতেন তা হলে তিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন বলে প্রতীয়মান হয় কারণ, গুরুদেব ছিলেন তাঁর সারাজীবনের আরাধ্য জীবনদেবতা! এরকম নারীভক্ত রবীন্দ্রনাথের জীবনে বিরলই বলতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ এবং বিপ্লবী রাসবিহারী বসু সম্পর্র্ক
দ্বিতীয় ঘটনাটি বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক। বিহারী বসু ১৯১৫ সালে জাপানে পালিয়ে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর জাপানপ্রবাসী হওয়ার আগে কি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল? যতখানি তথ্যাদি পাঠ করা গেছে তাতে এর সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। একাধিক গ্রন্থাদি থেকে জানা যাচ্ছে যে, ১৯১২ সালে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু কর্তৃক গৃহীত গভর্নর লর্ড হার্ডিঞ্জ হত্যা পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে পরে দুই বছরকাল পালিয়ে পালিয়ে থাকেন বিভিন্ন জায়গায়। ব্রিটিশ সরকার কিছুতেই ধরতে পারেনি কে এই ষড়যন্ত্রের নায়ক। কিন্তু দুই বছর পর ১৯১৪ সালে যখন ধরা পড়ে যে দুর্ধর্ষ স্বদেশী রাসবিহারী বসু মূল অপরাধী তখন তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়না জারি হয় আলোকচিত্রসহ। তখন তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ভারতত্যাগের। কিন্তু কীভাবে? এই বছর সংবাদপত্র মারফত সংবাদ জানতে পারেন যে, সদ্য নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণে যাচ্ছেন। তিনি জানতেন ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন বিপ্লবী জাপানে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তখন তিনি চিন্তা করে দেখেন এইই সুযোগ জাপানে চলে যাওয়ার। যেমন ভাবা তেমন কাজ। প্রস্তুতি নিয়ে নিলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় সেজে কবির জাপানভ্রমণের প্রস্তুতিকল্পে আগে চলে যাওয়ার। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি পিএন ঠাকুর (প্রিয়নাথ ঠাকুর) ছদ্মনাম ধরে জাপানি জাহাজে চড়ে ১৯১৫ সালে জাপানে প্রবেশ করেন। রবীন্দ্রনাথের এই প্রথম জাপান ভ্রমণের সংবাদ কী রকম সুদূরপ্রসারী ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেটা কল্পনাও করতে পারেননি বলে মনে করা যায়। রাসবিহারী বসু দেরাদুনে থাকাকালীন সেখানে রবীন্দ্রনাথের এক আত্মীয় প্রিয়নাথ ঠাকুর বসবাস করতেন এই তথ্য জানতেন। সুতরাং এই নামে তিনি জাপানে গেলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না কারণ এক দশকেরও অধিক আগে ১৯০২ সালে জাপানের বহুশ্রুত প্রভাবশালী মনীষী এবং শিল্পকলার ইতিহাসবিদ ওকাকুরা তেনশিনের সঙ্গে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব এবং জাপানের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ফলে ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় সেজে জাপানে প্রবেশ করতে তাঁর জন্য তেমন কোনো বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়নি। জাহাজে চড়া এবং অবতরণ পর্যন্ত সকল যাচাই-বাছাই পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

এদিকে প্রকৃত ঘটনা জানা যায় সেইসময় কলকাতায় অবস্থানরত জাপানি বৌদ্ধপণ্ডিত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি বিভাগের অধ্যাপক, বাংলা ভাষার সুপণ্ডিত এবং রবীন্দ্রনাথের বন্ধু কিমুরা নিক্কির লিখিত রাসবিহারী বসু স্মরণসংক্রান্ত স্মৃতিকথা থেকে। সেখানে তিনি লিখেছেন: “.....১৯১৪ সালের হেমন্তে কবি জাপানভ্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ‘আগামী বছর জাপানে যাবো তাই তুমি দোভাষী হিসেবে আর প্রস্তুতিকল্পে আগে জাপানে চলে যাও না!’ বলে আমাকে অনুরোধ করেন।”.......“সেই সংবাদই পত্রিকায় প্রকাশিত হলে পরে মি.বোসের নজরে আসে। মি.বোস কবির আত্মীয় সেজে তাঁর জাপান ভ্রমণের প্রস্তুতির জন্য পিএন ঠাকুর নামে জাপানের সানুকিমারু জাহাজে জাপানের পথে রওয়ানা হন (এই কথা আমি মি. বোসের কাছে পরে শুনেছি)। এইভাবে আমার কিছু আগে-পরে জাপানে পৌঁছেন তিনি। কবি তার পরের বছর ১৯১৬ সালে জাপানভ্রমণ করেন, এটাই তাঁর প্রথম জাপানভ্রমণ।” ৪। (অনুবাদ)।

রবীন্দ্রনাথ যখন জাপানে আসেন তখন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানে পলাতক। তাঁর মাথার ওপর ব্রিটিশ সরকার- ঘোষিত ১২ হাজার রুপির পুরস্কার ঝুলছে ধরিয়ে দেবার জন্য। ব্রিটিশের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ জাপান সরকার কর্তৃক জাপানত্যাগের আদেশপ্রাপ্ত হন বিহারী বসু এবং তাঁর অব্যবহিত পরক্ষণে জাপানে পালিয়ে আসা সহকর্মী বিপ্লবী হেরম্বলাল গুপ্ত দুজন। তখন জাপানে অনুরূপ পলাতক ছিলেন চীনের জাতীয়তাবাদী নেতা বিপ্লবী ড.সান ইয়াৎ-সেন । তাঁকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিলেন গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু। বিহারী বসু সান-ইয়াতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সান-ইয়াৎ তাঁকে তাঁর আশ্রয়দাতা গুরু তোওয়ামা মিৎসুরুর কাছে নিয়ে যান এবং পরিচয় করিয়ে দেন। তৎকালীন প্রবল প্রতাপশালী কট্টর জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু তাঁকে এবং বিপ্লবী হেরম্বলাল গুপ্তকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। পুলিশের গ্রেপ্তার থেকে রক্ষা করে তৎকালীন টোকিওর সুবিখ্যাত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘নাকামুরায়া’ ভবনের পরিত্যক্ত একটি চিত্রাঙ্কন সটুডিও বা আটলিয়ের এর ভেতরে লুকিয়ে রাখেন তাঁদেরকে। বিহারী বসু কি তখন গুরু তোওয়ামাকে ‘পিএন ঠাকুর’ বলে নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন? সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। ‘নাকামুরায়া’তেও বেশিদিন রাখা যায়নি লুকিয়ে। পুলিশ খোঁজ পেয়ে গেলে সেখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। এভাবে অনেক জায়গায় লুকিয়ে লুকিয়ে পলাতক জীবন অতিবাহিত করতে হয় বিহারী বসুকে। রবীন্দ্রনাথ প্রায় তিন মাস জাপানে অবস্থান করলেও এই পলায়নপরতার কারণে বিহারী বসু সাক্ষাৎ করতে পারেননি বললে অত্যুক্তি হয় না।

শেষ পর্যন্ত যখন আর উপায়ন্তর নেই তখন গুরু তোওয়ামার পরিকল্পনায় নাকামুরায়া প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সোওমা আইযোওর কন্যা সোওমা তোশিকোর সঙ্গে বিহারী বসুর বিবাহ সম্পন্ন করা হয় ১৯১৮ সালে। বিয়ের পরও নবদম্পতিকে টোকিওর বিভিন্ন শহরে ১৭ বার বাসা বদল করে লুকিয়ে-লুকিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। এই অনিশ্চিত জীবনের মধ্যেই স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য নিরলস কাজ করেছেন বিহারী বসু। বিবাহের পর তিনি হয়ে উঠলেন ‘নাকামুরায়া নো বোউসু’ অর্থাৎ ‘নাকামুরায়ার বসু’ এই নামে তিনি আজও জাপানে সুপরিচিত। ১৯২৩ সালে তিনি জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করে মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু ততদিনে অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং ঠাণ্ডাজনিত কারণে নিউমোনিয়া (পক্ষান্তরে যক্ষ্মা) রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯২৫ সালে মাত্র ২৬ বছরের তরুণপ্রাণ তোশিকো বসু ইহলোকত্যাগ করেন। স্ত্রীর ভালোবাসার প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি আর দ্বিতীয় বিবাহ করেননি শাশুড়ি সোওমা কোক্কোর অনুরোধ সত্ত্বেও। অত্যন্ত নীতিজ্ঞানসচেতন মানুষ ছিলেন রাসবিহারী বসু।

এই ঘটনার দুবছর পর শ্বশুরের সহযোগিতায় নাকামুরায়া প্রতিষ্ঠানের দ্বিতলে ‘ইনদো নো মোন’ বা ‘ভারতীয় তোরণ’ নামে একটি কারি রেস্টুরেন্ট চালু করেন। সেই রেস্টুরেন্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এখানেই অন্যান্য প্রবাসী বিপ্লবীরা আসাযাওয়া করতেন, সম্মিলিত হতেন জাপানি সমর্থকবৃন্দ এবং বিভিন্ন স্তরের প্রভাবশালী ব্যক্তি যাঁরা ছিলেন রাসবিহারী বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু; আলোচনা সভা ও কারি-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। বিহারী বসুর তৈরি আসল ‘ইনদো কারি-রাইস’ বা ‘ভারতীয় কারি’ আজও জনপ্রিয় এবং কিংবদন্তি। নিরলস কর্মবীর বিহারী বসু গুরু তোওয়ামা মিৎসুরুর ছত্রছায়ায় মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য আপোষহীনভাবে। ১৯৪৫ সালের ২১ শে জানুয়ারি তিনি স্বগৃহে মৃত্যুবরণ করেন।

রবীন্দ্রনাথ জাপানভ্রমণকালে তো বটেই ভারতেও বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর জাপানে পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ নিশ্চয়ই অবগত হয়েছিলেন। ১৯১৬ সালে কি তাঁদের জাপানে সাক্ষাৎ হয়েছিল? তিনি কি আগ্রহী হয়েছিলেন বিহারী বসুর সঙ্গে একটিবার সাক্ষাৎ করার জন্য? সেই তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা না হলেও রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে যে একজন ভারতীয় স্বদেশী যোদ্ধা দূরপ্রাচ্যের দেশ জাপানে এসে লড়াই করে অন্যান্যদের থেকে বহুদূর অগ্রগামী ছিলেন এটা জেনে পরিতৃপ্তি লাভ করেছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তারই প্রমাণ মিলে ১৯২৪ সালে তৃতীয় ভ্রমণের সময়। এই বিষয়ে রাসবিহারী বসুর কন্যা হিগুচি তেৎসুকোর বর্ণনায় পাওয়া যায়: “রবীন্দ্রনাথ জাপানে আগমন উপলক্ষে (এখানে) আসার পূর্বে চীনের পিকিং থেকে রাসবিহারীকে একটি চিঠি পাঠান। টোকিওতে থাকাকালীন তাঁর সহযোগিতা কামনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ জাপানে পৌঁছানোর পর বিহারী বসুর সাক্ষাৎ লাভ করেন। ভারতীয় স্বাধীনতার বিষয়ে পরস্পর মতবিনিময় করেন।” ৫ (অনুবাদ।)

এই সময় রবীন্দ্রনাথ রাসবিহারী বসুকে উৎসাহিত করেন স্বদেশের স্বাধীনতা অর্জনে লড়াই করে যাওয়ার জন্য। এই সাক্ষাতের সংবাদ গুরু তোওয়ামাসহ তখনকার অন্যান্য প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী যাঁরা বিহারী বসুর ঘনিষ্ঠ শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন তাঁরা অবগত হন। বিহারী বসু কেন ‘পিএন ঠাকুর’ নামে জাপানে প্রবেশ করেছিলেন এর গুরুত্ব তাঁরা এবার অনুধাবন করতে পারেন। রাসবিহারী বসু যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এটা জাপানিদের কাছে আরও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। ফলে গুরুদেবের এই আশীর্বাদ নিয়ে বিহারী বসু জাপানে নব উদ্দীপনা নিয়ে জাপানি নাগরিকদের সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যেতে থাকেন সরকারি বাধা-নিষেধ-বিপত্তি সত্ত্বেও।

এই সময় কবিগুরু বিহারী বসুর শ্বশুরালয় ‘নাকামুরায়া’ ভবনে যান এবং তাঁর পরিবার ও শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। এই তৃতীয় ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হলো গুরুদেবকে গুরু তোওয়ামা মিৎসুরুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া। কবিগুরুকে এক জমকালো সংবর্ধনা প্রদান করা হয় গুরু তোওয়ামার গুপ্ত রাজনৈতিক সংগঠন ‘গেনয়োওশা’র উদ্যোগে টোকিওর উয়েনো সেইয়োওকেন্ রেস্টুরেন্টে জুন মাসের ১২ তারিখে। সংবর্ধনার একাধিক স্মারক আলোকচিত্র সেই ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী বহন করছে। উক্ত অনুষ্ঠানে গুরু তোওয়ামার দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাপানে আশ্রিত ভারতীয়দের (বিপ্লবী) প্রতি তোওয়ামার সেবা-সহযোগিতার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এই সংবর্ধনা জাপান-বাংলা-ভারতের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। শুধু তাই নয়, ১৯২৯ সালেও রবীন্দ্রনাথ গুরু তোওয়ামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী হন কিন্তু তিনি তখন চীন ভ্রমণে থাকার কারণে সাক্ষাৎ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি লিখে রেখে যান, তাতে মানবজাতির কল্যাণে তোওয়ামার নিবেদিতপ্রাণ উদারতা, উৎসর্গমর্মিতার জন্য ভূয়সী প্রশংসা এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এইভাবে ১৯৪৩ সালে ক্রমাগত অগ্রসরতার আরেকটি ঐতিহাসিক ধাপ অতিক্রম করতে সক্ষম হন রাসবিহারী বসু ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা সুভাষচন্দ্র বসুকে জাপানে নিয়ে আসতে জার্মানি থেকে প্রভূত প্রভাবশালী জাপানি রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্মকর্তাদের সহযোগিতায়। এরপরের ঘটনা তো জানা-অজানা ইতিহাস দুদেশের মধ্যেই।

এই ১৯২৯ সালেই রবীন্দ্রনাথের শেষ জাপান ভ্রমণের সময় রাসবিহারী বসু কবিগুরুর থাকার ব্যবস্থা করেন তাঁরই বন্ধু শিল্পপতি এবং চিন্তাবিদ ড.ওওকুরা কুনিহিকোকে অনুরোধ করে কুনিহিকোর টোকিওস্থ প্রাসাদোপম বাসভবনে। এখানে রবীন্দ্রনাথ তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন এবং কুনিহিকোর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বে বাঁধা পড়েন। দুজনের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিনিময় হয়। কুনিহিকো কবিকে অকৃত্রিম আতিথেয়তা প্রদান করেন।

সেই সম্পর্ক এতই মধুরতম গভীর ছিল যে, কবিগুরুর শততম জন্মবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে অসামান্য ভূমিকা রাখেন ড.কুনিহিকো। প্রায় সাড়ে তিন বছরের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন ১৯৫৮ সালেই। তিনি হন ‘টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশনে’র প্রেসিডেন্ট। কী বিপুল পরিমাণ কাজ ও অনুষ্ঠান হয়েছে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া এককথায় কঠিন! এই ইতিহাস আমি রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ এবং জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক’ গ্রন্থে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করেছি। গ্রন্থটি এই বছর আত্মজা পাবলিশার্স, কলকাতা থেকে পুনর্মুদ্রিত হয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ ও জাপান: শতবর্ষের সম্পর্ক’ নামে।

প্রকৃতপক্ষে, রবীন্দ্রনাথ এবং ওকাকুরার প্রাচ্যবন্ধনের প্রভাবেই ২০১১ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বড়মাপের ‘ইন্ডিয়া-জাপান গ্লোবাল পার্টনারশিপ সামিট’---বেসরকারিভাবে তিন দিনব্যাপী। দুটোর পেছনেই ছিল দুটি সরকারের ব্যাপক সহযোগিতা। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপানভ্রমণ তাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই ভ্রমণকে কেন্দ্র করে রাসবিহারী বসু যদি জাপানে না আসতেন তা হলে জাপান-বাংলার রাজনৈতিক সম্পর্ক যেমন গড়ে উঠতো না, জাপানে আসতে পারতেন না নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু---যাঁকে রবীন্দ্রনাথ ‘রাষ্ট্রনায়ক’ বলে অভিহিত করেছিলেন; গঠিত হতো না আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং নেতাজির নেতৃত্বে ভারতের মনিপুর রাজ্যের ইম্ফল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা হতো না জাপানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে গেলেও রাসবিহারী বসু ও নেতাজির বিচক্ষণ দেশপ্রেমের কারণে আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনারা বিদ্রোহ করে এবং ঘটনাক্রমে ইংরেজরা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়---বহু বছরের আরাধ্য স্বাধীনতা লাভ করে ভারত ১৯৪৭ সালে।

শুধু তাই নয়, যে সকল প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী যাঁরা গুরু তোওয়ামার স্নেহধন্য বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সমর্থক ছিলেন তাঁদের অনুসারীরাই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জাপানে জনমত গঠন, অর্থ সংগ্রহ এবং বিভিন্ন সহযোগিতার মাধ্যমে বাঙালিকে সমর্থন করেছেন। ১৯৭২ সালেই স্বীকৃতি প্রদান করেছে জাপান স্বাধীন বাংলাদেশকে। ১৯৭৩ সালে এক অভাবনীয় সংবর্ধনা প্রদান করা হয় টোকিওতে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্বাধীনতার পর পর ১৯৭২ সালে জাপান সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাপান সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকায় তিনজন বিশিষ্ট জাপানি নাগরিককে পাঠান। তাঁরা হলেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সাংসদ ও প্রাক্তন শ্রম মন্ত্রী হায়াকাওয়া তাকাশি, নেতাজির সহযোদ্ধা জেনারেল ফুজিওয়ারা ইওয়াইচি এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক, লেখক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তানাকা মাসাআকি। জাপান সরকারের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই সংবর্ধনা সভায় তৎকালীন জাতীয়তাবাদী নেতা প্রধান মন্ত্রী তানাকা কাকুয়েই তাঁর উদ্বোধনী বক্তৃতা শুরু করেছিলেন ওকাকুরা-রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস দিয়ে।

জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক