লিটন শরীফ, বড়লেখা ( মৌলভীবাজার) : মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরপাড়ের বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার ১৫ হাজার মৎস্যজীবি বছরে ৬ মাস মাছ ধরেই পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। কেউ কেউ বাকি ৬ মাস বোরো ও রবি শস্য ফলিয়ে এবং অন্যরা অলস সময় পার করে। কিন্তু এবার চৈত্র মাসে বোরো ও রবি শস্য হারায় এসব মৌসুমী জেলে কৃষকরা। পরে দফায় দফায় ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় ঘরবাড়ি ভেঙ্গে ও পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে উঠে। প্রায় সাড়ে ৩ মাসের দীর্ঘ বন্যায় চরম জীবিকা সংকটে পড়েছে এসব মৎস্যজীবি।

বড়লেখা উপজেলার হাল্লা, খুটাউরা, আহমদপুর, মুর্শিবাদকুরা, মুন্সিনগর, নোয়াগাঁও, ইসলামপুর, কাজিরবন্দ, কান্দিগ্রাম এবং জুড়ী উপজেলার বেলাগাঁও, সাহাপুর গ্রামে বেশিরভাগ মৎস্যজীবি পরিবারের বাস। এসব এলাকায় বন্যার পানি গত ২দিন কিছুটা কমলেও শুক্রবার থেকে বাড়তে থাকায় দুর্ভোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এ দুর্দিন তাদের পিছু ছাড়ছে না। ঘরবাড়ি বন্যায় তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই হাওরে মাছ ধরতে যাচ্ছে না। কিছু জেলে হাওরে জাল নিয়ে গেলেও গভীর ভাসান পানির কারণে জালে মাছ আসছে না। অনকেকে খালি হাতেই ঘরে ফিরতে হচ্ছে। অন্যরা যা পান, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ মাঝে-মধ্যে ত্রাণও পেয়ে থাকেন। আর তা দিয়েই দুই একদিন চলে। এরপরই কোথাও না কোথাও হাত পাততে হচ্ছে তাদের।

বড়লেখার তালিমপুর ইউনিয়নের মুর্শিবাদকোরা গ্রামের কামাল মিয়া জানান, হকলতা যারগি পানির মুরো (সবকিছু পানির নিচে চলে যাচ্ছে)। গরিব মানুষ। বছর বছর বাঁশ-বেড়া দিয়া ঘর বানাই। ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ অয়। এমনিতেই এবার পানিয়ে খেত (বোরো ধান) খাইলিছে। হকল মানুষ মরাত (সবাই ক্ষতিগ্রস্ত)। এখন চারদিকে পানি। কিন্তু মাছ মিলে না। সারা দিনে দুই/আড়াই’শ টাকার মাছ পাই। কোনো দিন খালি খাওয়ার মাছ মিলে। আফাল (ঢেউ) থাকলে কিছুই মিলে না। এক কেজি চাউলর দাম ৫০ টাকা। আটজনের পরিবার। উফাস-কাফাস করি চলিয়ার। মাঝে-মধ্যে ঋণ করি। তিনি আরও জানান, তিনি নিবন্ধিত মৎস্যজীবি। এ পর্যন্ত কোন ত্রাণ পাননি।

অর্ধ নিমজ্জিত বারান্দায় কলাগাছে বসে জনৈক নারী জাল বুনছেন। পাশেরজন তরকারি কুঁটায় ব্যস্ত। টুনু মিয়া জানান, ১০ কিয়ার (বিঘা) খেত করেছিলাম। সব পানিয়ে ভাসাই নিছে। খেত করি ১৭ হাজার টাকা দেনা অইছে। কিলা (কীভাবে) শোধ করতাম ? পানি কমলে না রুজি করতাম। ৩ মাস তাকিই পানি কমের না। দিনে দুই-আড়াই’শ টাকার মাছ পাই। এই টাকায় খালি চাউল কিনলেই চলেনি। অন্য খরচও তো আছে। ওষুধও লাগে। টানাটানি করি কোনো রকম চলরাম। সরকারী কোনো ত্রাণ পাইছি না। একই বাড়ির রাবেয়া বেগম, হোসনা বেগম জানালেন, তারা কোনো সাহায্য পাননি। তবে রুজিনা বেগম বলেন, তিনি ৮ কেজি চাল পেয়েছেন। ইনাম মিয়া জানান, তারা ১৩ জন প্রত্যেক দিন দু’টি নৌকা নিয়ে হাওরে মাছ ধরতে যান। সবাই মিলে দেড়/দুই হাজার টাকার মাছ পান। এতে প্রতিজনে ১০০-১৫০ টাকা পান। কোনো দিন খালি হাতে ফিরেন। তিনি ১০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন। বন্যার কারণে একমুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারেননি।

বড়লেখা মৎস্য অফিসার সঞ্জয় ব্যানার্জি ও জুড়ী মৎস্য অফিসার আব্দুস শাকুর হাকালুকি হাওরপাড়ের দুই উপজেলার জেলেদের জীবিকা সংকটের সত্যতা স্বীকার করে জানান, বিকল্প পেশা না থাকায় তাদের চরম দুর্দিন চলছে। বড়লেখায় নিবন্ধিত মৎস্যজীবির সংখ্যা ২ হাজার ৩শ’ ৪৮ জন এবং জুড়ীতে ১৭০৫ জন। এছাড়াও কয়েক হাজার অনিবন্ধিত মৎস্যজীবি রয়েছে। নিবন্ধিত জেলেদের স্মাটকার্ড তৈরী করা হয়েছে। সরকার তাদের সাহায্য সহযোগিতার চিন্তা ভাবনা করছে।

(এলএস/এসপি/জুলাই ১৭, ২০১৭)