স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা : ভেজালের আরেক নাম প্রাণ। খবরটি সত্যিই আতঙ্কের। নাম ‘প্রাণ’ অথচ প্রাণেই ভেজাল। ফলের রসের নামে মিষ্টি কুমড়া ব্যবহার করে প্রতিনিয়িত দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা যাচ্ছে এই নামধারী কোম্পানি প্রাণ।

এই কোম্পনির কোনো ফলের জুসে নেই ফলের রস। কৃত্রিম সুগন্ধি ব্যবহার করে মিষ্টি কুমড়ার সঙ্গে ম্যাংগো ফ্লেভার মিশিয়ে দিয়ে তৈরি করছে এসব জুস। মিষ্টি কুমড়ার সঙ্গে যেটুকু আম ব্যবহৃত করা হচ্ছে তা বিষাক্ত ফরমালিন যুক্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাণ ভেজাল জুস বা ফ্রুট ড্রিংকস খেয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এই জুসে এসিটিক এসিডের পরিমাণ ৫-৬ শতাংশ । জুস ও ফ্রুট ড্রিংকসে সাধারণত এ উপাদান ১ শতাংশের নিচে থাকার কথা।

এই কোম্পানি শুধু ভেজাল দিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি বিপননেও চলছে দেশের মানুষের সঙ্গে ব্যাপক প্রতারণা। ইতোমধ্যে এই নামধারী কোম্পানি প্রাণ বাংলাদেশ ও ভারতের বড় বড় সব চ্যানেল পত্রিকা দখল করে ব্যাপক প্রচারণা চারিয়ে যাচ্ছে।

দিন দিন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অবৈধ্য ভাবে টাকা কামিয়ে নিজেদের পকেট ভরছে। শুধু বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে তা নয় তাতেও রয়েছে শুভাংকরের ফাঁকি। নিচে একটি সেল নম্বার (০১৯৭৭২৬৭২৫৩) দেওয়া আছে। কল করলে ড্রিংকস কি হিসেবে দেবে বা মূল্য আদৌ নেবে কিনা-বিজ্ঞাপনে এসব উল্ল্যেখ নেই। এই নম্বরে ফোন না করে আদৌ আপনি জানতে পারবেন না যে বিজ্ঞাপনটির আড়ালে কি লুকিয়ে আছে।

এদিকে বিজ্ঞাপনে বিষয়টি খোলামেলা ভাবে বলা হয়নি কেন? বিষয়টি জানতে চাইলে প্রাণ কোম্পানিতে কমরত তানভীর বলেন, এটা আমরা জানি না আপনি আমাদের মাকের্টিং অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন বলে একটি নম্বার দেন। তবে এ নম্বরে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও নাম্বারটির (০১৯১২২৫৭০১২) সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে, প্রাণ জুস তৈরির উদ্দেশ্যে কেনা আমে পরীক্ষা করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ তথ্য। প্রতিনিয়তই প্রাণের জুসে পাওয়া যাচ্ছে ভেজাল, কিছুদিন আগে জুসের বোতলে পাওয়া গেছে নাট-বল্টু।

রাজীব ঘোষ নামে একজন পথচারী উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, এই গরমে ঠান্ডা কিছু কে না খেতে চাই। আমিও একটি দোকান থেকে প্রাণ ম্যাংগ জুস নেই। তারপর বোতলের মুখ খুলে দেখি তার ওপর কি যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। দোকানে গিয়ে ঐ জুসের বোতল দেখালে সেই জুসের বোতল আর ফেরত নেয়নি।

খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) পরীক্ষায় এই ভেজালের প্রমাণ মিলেছে। প্রাণের এমন এসব ভেজাল জুস খাওয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা।

শিশু ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা জানান, এ ধরনের পানীয় মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। ১০ বছর আগেও দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা ছিল ৮০ লাখ। এখন এ সংখ্যা দুই কোটির বেশি এবং তাদের অর্ধেকই শিশু। এছাড়া দেশে বছরে অনড়ত ৮৪ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। কৃত্রিম সুগন্ধি মেশানো এসব পানীয় গর্ভবতী ও বৃদ্ধদের জন্যও ক্ষতিকর। তাদেরও কিডনি ও লিভার আক্রান্ত হতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, ফরমালিন শরীরে প্রবেশের পর লিভার বা যকৃতে মিথানল এনজাইমের উপস্থিতে প্রথমে ফরমালডিহাইড এবং পরে ফরমিক অ্যাসিডে পরিণত হয়। তাৎক্ষনিকভাবে পেটের পীড়া, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগ হয়ে থাকে। এমনকি লিভার ক্যান্সারও সৃষ্টি করতে পারে।

ফরমালিন যুক্ত ফলমূলসহ অন্যান্য খাবার গ্রহণের ফলে ফুসফুসের কার্য ক্ষমতা নষ্ট, হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, আ্যাজমা রোগের উপদ্রব হয়। ফুসফুস, শ্বাসনালীতে ক্যান্সার হতে পারে। বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, মাথাব্যথা ও চোখ জ্বালাপোঙা করতে পারে এবং ফরমালিনযুক্ত মাছ পাকস্থলী, ফুসফস ও শ্বাসনালীতে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। এছাড়া ও ব্লাড ক্যান্সার, চোখের যতি কমে যেতে পারে।

এদিকে ২০১২ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) দেশের বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত ৭২টি জুস ও ফ্রুট ড্রিংকসের নমুনা পরীক্ষা করে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরি।

এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. সুবিমল সিংহ চৌধুরী উত্তরধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, ২০১২ সালে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ৭২টি জুস পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এগুলোর প্রতিটিতেই মাত্রাতিরিক্ত এসিটিক এসিড পাওয়া গেছে। ভেজালকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ইনস্টিটিউটের সরাসরি কোনো আইন প্রয়োগের সুযোগ নেই। তাই বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ সচিব এমএম নিয়াজ উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করবে।

(এটি/এপ্রিল/১১, ২০১৪)