অরবিন্দ পাল অখিল


সৃজনীশক্তি তথা সৃজনশীলদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার এক উদ্ভট প্রতিযোগিতা চলছে বাংলাদেশে। বিষয়টি স্পষ্ট হয় এ বছরের প্রথম দিকে শিক্ষা পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের পর সারাদেশে আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। এ ধারা মনে হয় এখনও থেমে যায়নি।

আরোপিত শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা কি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে আধুনিক আর মানবিক করে গড়ে তুলতে পারব? মোটেই না। অবৈজ্ঞানিক মানদন্ডে সোনালী পাঁচের সংখ্যা বাড়ার সাথে শিক্ষা বা মেধা উন্নয়নের কোন সম্পর্ক নেই তা শিক্ষাবিদেরা ইতোমধ্যে মেনে নিয়েছেন। কাউকে তোষণ করতে শিক্ষার্থীদের আমরা অসৃজনশীল করে ওদের মন মানসিকতা ভয়ঙ্কর করে তুলছি না তো! এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়াটা কি অস্বাভাবিক। কোচিং আর প্রাইভেট নির্ভর শিক্ষার্থীরা আর কিছু করতে না পারলেও মেরুদন্ডহীন তথাকথিত বা ডিজিটাল জ্ঞানী হয়ে উঠেছে। যতই বাগাড়ম্বর করা হউক না কেনো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী মহোদয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (মফস্বল) শিক্ষার্থী ধরে না রাখতে পারলেও প্রাইভেট আর কোচিং সেন্টারগুলোতে বাড়তে থাকা ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা আর সিফট করতে কোন বাঁধা দিতে পারেননি। স্কুল-কলেজ সময়েই চলে এসব অবৈধ কর্মকান্ড।

নকল বন্ধের পরিবর্তে ব্যাপক নকলের পসড়া বসছে পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে। প্রশ্ন ফাঁসের ব্যপারে বিব্রত সংশ্লিষ্টরা। শিক্ষকদেরও করার কিছু নেই শুধু পাহাড়া দেয়া ছাড়া। অভিভাবক আর শিক্ষার্থীদের নিজেদেরও কিছু করার নেই। মনোজগৎ পরিবর্তনের যেসব ক্ষেত্র রয়েছে ওসবের চর্চা নেই। নেই শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করা বা নিজের একটু পড়ার সুযোগ। স্বাধীন কোনকিছু চিন্তা ও প্রয়োগ করার সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলছে তারা। যেখানে সৃজনশীলতার চর্চা সেখানেই আঘাত, বিগত সময়ে এ আঘাত অপ্রকাশ্যে চললেও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ সরকার কাউকে তোষামোদ বা কারো মন রক্ষার্থে সৃজনশীলতার গোড়ায় প্রকাশ্যেই কুঠারাঘাত করছেন এমন বললে কথাটি খুব বেশী বলা হবে না।

সম্প্রতি বরগুনা উপজেলা ইউএনও নিগ্রহের ঘটনাটি একটি বড় প্রমান। পত্রিকার খবরে জানা যায়, ইউএনও গাজী তারিক সালমান আগৈলঝড়ায় দায়িত্ব পালনকালে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের নিমন্ত্রনপত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ছাপা হয়। ছবিটি জাতির জনকের জন্মদিনে শিশু চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। মামলার বাদী আওয়ামীলীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ওবায়েদ উল্লাহ রাজুর আর্জিতে ছবিটি নাকি ‘বিকৃত।’ কি যে শিশু পরম মমতায় জাতির জনককে এঁকে প্রথম হয়েছিল এ ছবি আঁকার অপরাধে আমরা ধরে নিতে পারি আঁকিয়ের সাজাও হতে পারে। আমরা নিশ্চিত প্রথম স্থান অর্জনকারী শিশুটি এখন আতংকে ভুগছে। ওইসব চিত্রের বিচারকদেরও বিচারের সম্মূখীন হতে হবে কেন তারা বিকৃত ছবিকে প্রথম স্থান দিলেন। ঘটনাপ্রবাহ এমনই ঈঙ্গিত বহন করে।

একজন সৎ প্রগতিশীল ও সৃজনশীল অফিসারকে রাজনৈতিক কোপানলে পড়ে হেনস্তা হতে হলো। শুধু তাই নয় বাদীর বড় অপরাধ হল তিনি শিশু মানসকে আতংকিত করে তুলেছেন। রাজনৈতিক হীন বাসনা চরিতার্থে তা করা হলেও এ বিষয়টিকে ছোট এবং বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিলে অবিমৃষ্যকারিদের প্রশ্রয় দেয়া হবে। সমাজে কূপমন্ডুক আর পশ্চাদপদদের বিচরণ বাড়ছে রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায়। নেতাদের এখন জনগণের সমর্থনের প্রয়োজন পড়ে না। এজন্য জনগণের প্রতি তাদের কমিটমেন্টও নেই। জনসমর্থনহীন ক্ষমতারোহণ খুবই মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এসব উদ্ভট উটকো কুপমন্ডুকদের বাড়বাড়ন্ত দেশের জন্য অমঙ্গলই বয়ে আনবে।

সর্বশেষ সংবাদে আওয়ামীলীগ ওই কুপমন্ডুককে সাময়িক বহিস্কার করেছে। এতেই কি শেষ। ছবি নিয়ে যে পেনিক বা আতংক সৃষ্টি হয়েছে তা দূর হবে কি। আমরা কোমলমতি শিশুদের সৃষ্টিশীল মননকে কি চির ধরিয়ে দিলাম না? সমগ্র দেশের শিশুরা জেনে গেছে জাতির জনকের ছবি অবিকল না হলে জেলে যেতে হয়। এখন হয়তো লুকিয়ে লুকিয়ে জাতির পিতাকে আঁকতে শিখবে। নতুবা কখনোই আর আঁকবে না। এভাবেই সৃষ্টিশীলদের আতংকিত করা হচ্ছে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ওই গাড়লটাকে বহিষ্কার করা হয়েছে সত্য এর আগে সে কত না অমানবিক আচরণ করেছে। আমরা এই অন্যায়ের প্রতিবাদী হয়ে ওই আইনজীবী নেতার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। কারণ তার অপরাধ অগ্রগতি রোধ করার তার অপরাধ প্রগতি থামিয়ে দেয়ার তিনি আমনবিক আচরণকারীও। হেফাজতীদের এজে বাস্তবায়নকারী কাওয়াদের দল থেকে নির্বাসনে পাঠানো জরুরী হয়ে পড়েছে। আমরা আশাবাদী যে একাত্তরে যে আশায় এ দেশের অতি সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করেছিল সেই সাধারণ মানুষেরা জেগে উঠবে। কারণ সৃষ্টিশীলদের কখনও রোধ করা যাবে না যায় না।


লেখক : সাংবাদিক।