জয়পুরহাট প্রতিনিধি : জয়পুরহাটের ১০ হাজার মুরগি খামারের অধিকাংশই কখনো লাভে আবার কখনো লোকসানে পড়ে যায়। লাভ-লোকসানের এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে এ শিল্পে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানে থাকা লক্ষাধিক মানুষের উপার্জনের পথও চলছে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় বর্তমানে আড়াই হাজার নিবন্ধিত খামারসহ ছোট-বড় প্রায় ১০ হাজার মুরগির খামার রয়েছে। প্রতিমাসে এ খামারগুলো থেকে গড়ে ১ কোটিরও বেশি ডিম ও ১০ হাজার মেট্রিক টন মাংস উৎপাদন হয়। এতে জেলার ১০ লাখ মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ করার পরও প্রতিদিন ট্রাক ও পিক-আপ মিলে ১৫-২০ গাড়ি মুরগি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। জেলায় পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় মুরগির বাচ্চার চাহিদা পূরণ করতে এখানে মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের জন্য ১টি সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৩৯টি হ্যাচারি স্থাপন করা হয়েছে। ৪০টি হ্যাচারি থেকে প্রতিমাসে প্রায় ৪০ লাখ মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করা হয়।

জয়পুরহাট পূরবী এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হক, পল্লী ফিড ইন্ডাস্ট্রিজের সত্ত্বাধিকারী মঞ্জুর হোসেন জাহাঙ্গীরসহ মুরগির খাদ্য প্রস্তুতকারকরা জানান, জেলায় বিপুল পরিমাণ পোল্ট্রি খামার গড়ে ওঠার কারণে বর্তমানে মুরগির খাদ্য কারখানা গড়ে উঠেছে ১১টি। যেখান থেকে প্রতিমাসে গড়ে ১৪ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য উৎপাদন করা হয়ে থাকে। তবে জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ সরকারি হাঁস-মুরগি খামারকে কেন্দ্র করে এখানে পোল্ট্রি জোন গড়ে ওঠার পর দীর্ঘ সময়ের মধ্যে নানা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছে এখানকার পোল্ট্রি শিল্প।

পদ্মা ফিড অ্যান্ড চিক্স লিমিেটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ারুল হক আনু, শেফালী পোল্ট্রি ফার্ম প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম আলমসহ পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অনেকে এ শিল্পের অস্থিতিশীলতার জন্য বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেন। কারণগুলো হলো- কাঁচামালের শতকরা ৮০ ভাগ আমদানি নির্ভর হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেশি, মুরগি ও ডিম রফতানি না হওয়া, চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের সমন্বয়হীনতা, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকা, খাদ্য-ওষুধ-ভিটামিনের দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি, অনেক সময় নিম্নমানের, খাদ্য-ওষুধ-ভিটামিন খাওয়ানোর ফলে রোগ-ব্যাধি মুক্ত না হয়ে বরং মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাওয়া বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সঠিক ওজন না হওয়া, মধ্যসত্ত্বভোগী ফরিয়া বা দালালদের দৌরাত্ম্য, পাইকারি ও খুচরা বাজার মূল্যের বড় পার্থক্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যোগাযোগ বিঘ্নিত হলে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুরগি ও ডিম সরবরাহ বন্ধ হওয়া, মুরগির বাচ্চা-খাদ্য-ওষুধসহ বিভিন্ন উপকরণ বাকিতে বেচা-কেনা, দরিদ্রসহ নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে দেশের মধ্যেই মুরগি ও ডিমের বাজার সীমিত হয়ে পরায় স্থানীয় বাজারগুলোতে বাড়তি চাপে মুরগি ও ডিমের বাজার অধিকাংশ সময় অস্থিতিশীল থাকে।

জয়পুরহাট শহরের আদর্শপাড়া এলাকার বাবু হোসেন, জামালগঞ্জ এলাকার সাহাদত হোসেন, পুরানাপৈল এলাকার খোরশেদ আলমসহ মাঝারি ধরনের অনেক খামারি জানান, মাংসের জন্য প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে ১২০-১২৫ টাকা খরচ হলেও খামারিরা ২-৪ টাকা কমবেশি পাচ্ছেন, সেখানে খুচরা বাজার মূল্য কেজি প্রতি ১৪৫-১৫০ টাকা পর্যন্ত। সোনালি জাতের মুরগি উৎপাদনে প্রতিকেজি ১৯০-১৯৫ টাকা খরচ হলেও খামারিরা লোকসান দিয়ে পাচ্ছেন ১৫০-১৬০ টাকা, আর খুচরা মূল্য বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়।

বর্তমানে মুরগির বাজারে ধস নামায় বিপাকে পড়েছেন হ্যাচারি মালিকরাও। জয়পুরহাট পদ্মা ফিডস অ্যান্ড চিক্স লিমিটেডের পরিচালক রাশেদুজ্জামান জানান, এখন প্রতিটি মুরগি বাচ্চার উৎপাদন খরচ ১৪-১৫ টাকা হলেও বিক্রি ৬-৭ টাকায়, তা-ও বাকিতে। চাহিদা না থাকায় বিপুলসংখ্যক একদিনের উৎপাদিত বাচ্চা নিয়ে আমাদের মতো অনেক হ্যাচারি মালিকই মহা বিপাকে পড়েছেন।

জয়পুরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র সহ-সভাপতি ও কিষাণ পোল্ট্রি হ্যাচারি অ্যান্ড ফিড লিমিটেডের সত্ত্বাধিকারী জিয়াউল হক জিয়া ও পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘এ শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পোল্ট্রি শিল্প স্থবির, না হয় ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা হলে পোল্ট্রি শিল্পে কর্মরত জেলায় প্রায় ১ লাখসহ সারা দেশে ৩০ লাখেরও বেশি নারী-পুরুষ বেকার হবে। তাই পোল্ট্রি শিল্পের এ দূরাবস্থা থেকে রক্ষা করতে এখানে মুরগির মাংস প্রসেসিং প্ল্যান্টসহ হিমাগার প্রয়োজন।

এছাড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি ভর্তুকিসহ রফতানির জন্য সরকারের পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে দাবি করেন তারা।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুস সালম সোনার কিছু সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘বর্তমানে এ সমস্যা সমাধানে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এ শিল্পে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে।

(ওএস/এসপি/জুলাই ২৭, ২০১৭)