চারণ গোপাল চক্রবর্তী


১৭৫৭ সালে’র ২৩ শে জুন  পলাশীর প্রান্তরে  সিরাজের করুন পরিণতিতে বাংলা’র স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো। সেই অস্তগামী সূর্য এই ভাগ্যাকাশে উদিত হতে সময় নিয়েছিলো প্রায় ২১৫ বছর।তমশাছন্ন থেকে আলোকচ্ছটার যাত্রায়  আত্মহুতি হয়েছে অগণীত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য’র শাসন-শোষনের বিরুদ্ধাচরণ করে জেল-জুলুম-জরিমানা ও আত্মবলীদান দিতেও কুন্ঠিত হয়নি অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ’র  সন্তানগণ। সেই সব লড়াই-সংগ্রামে  যে সূর্য-সন্তানদ্বয় মাথা উঁচু করে জানান দিয়েছিলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। বিদ্রোহী হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও পাকিস্থান সরকার’কে করেছিলো নতজানু। সেই সময়-কালের দুরন্ত এক লড়াকু শ্রেণী-সংগ্রামী কমরেড মণি সিংহ। আজ ২৮ জুলাই এই মহান বিপ্লবীর ১১৬ তম জন্মবার্ষিকী।

১৯০১ সালের ২৮ শে জুলাই,পূর্বধলার জমিদারের সন্তান কালীকুমার সিংহ ও সুসং রাজবংশের কন্যা শ্রীমতি সরলা দেবী’র কোল আলোকিত করে পশ্চীম বঙ্গের কলকাতা শহরে জন্ম নেন কমরেড মণি সিংহ। জন্মের দুই-তিন বছরের মাথায় পিতৃহারা জনিত কারণে আর্থিক সংকটে জন্য কলকাতা থেকে পাড়ি জমান ঢাকা মামা’র বাড়িতে। সেখান থেকে সুসং দুর্গাপুর মাতুল রাজ্যে। মা এর স্বল্প অংশীদারিত্বে’র জন্য বাড়ি-ভিটে, ফসলি জমি, মাসোয়ারা’য় সংসারের চাকায় গতিসঞ্চার ঘটে।স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন সুসং দুর্গাপুরে।প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখরি হয় সুসং থেকে।তারপর কলকাতা।মাত্র ১৩ বছর বয়সে যোগ দেন অনুশীলনে।

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন ‘অনুশীলনের’ চেতনায় বিশ্বাসী মন,লড়াকু হাজং’দের সংগঠীত করার জন্য সুসং থেকে মাইল দশ ক্রোশ দূরের গ্রাম কালিকাবাড়ি/পুর থেকে যাত্রা শুরু করেন বন্ধু উপেন সান্যাল কে সহচর নিয়। উচু-নিচু জাত-পাতের ব্যাবধান হটিয়ে শিক্ষা কে অস্ত্র হিসাবে বেছে নিয়ে স্থাপন করেন বিদ্যালয়।কুসংস্কারের বিরোধ করে সেই গ্রামে ক্রমশ হয়ে উঠেন জনপ্রিয়। অনুশীলন দলের উচ্চ মার্গীয় নেতা সুরেশ চন্দ্র দে এর পত্র নিয়ে কালিকাবাড়ী/পুর গ্রামে আসে রুশ বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তী। গোপেন চক্রবর্তী’র যুক্তি-অনুপ্রেরণায় পরিচিত হন মার্কসী’য় মতবাদের সঙ্গে।গড়ে উঠে সখ্যতা। মার্কস-লেলীন’বাদে উজ্জীবিত মণি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে ছুটে আসেন কলকাতা। সেখানে সখ্য’তা গড়ে উঠে কমিউনিজম মতবাদী নেতা কমরেড মোজাফফর সহ নানান বিপ্লবীদের সাথে। সেখান থেকে মিশন মেটোয়াব্রুজ লালঝান্ডা’র উত্থান ও সফলতা।

সন ১৯৩০, চট্টগ্রামে মাস্টার দা সূর্যসেন এর নেতৃত্বে অস্ত্র লুটে ভীত ইংরেজ প্রশাসন তাদের বিরোধ মতবাদকে দমনে হয়ে উঠে মরিয়া। এরই ধারাবাহিকতায় কলকাতা থেকে গ্রেফতার করা হয় কমরেড মণি’কে। ৫ বছর কাটে উপমহাদেশের বিভিন্ন জেলে। নিজ গ্রাম সুসং এ অন্তরীন অবস্থায় ও নিয়মিত হাজিরাদানের শর্তে ১৯৩৫ সালে জেল থেকে ছাড়া পান এই বিপ্লবী।

সন ১৯৩৭, নিজ বাড়ির আঙ্গীনায় পড়ে শোষীতে’র পদচারণ।খোদ নিজ পরিবাররের সামন্তদের অত্যাচারের লৌহমর্ষকতা পীড়িত করে কমরেড মণি সিংহকে। টঙ্ক প্রথার নামে কৃষক’দের যে জোর করে তার ন্যায্য অংশ থেকেও বঞ্চীত করা হচ্ছে, তিনি এই চরম বাস্তবতা উপলব্ধি করেন। যদিও প্রথমে নানাবিধ দ্বীধা-দন্দে ভোগেন। কিন্তু পরবর্তী’তে মার্কসীয় শিক্ষার আলোকে নিজেকে চালিত করে ঔ সব ভুখা-নাঙ্গা’দের মুক্তির মিছিলের নেতা হয়ে আসেন তিনি। গড়ে তুলেন দুর্বার আন্দোলন। নিজ পারিবারের এই বিদ্রোহী’র ভয়ে ভীত-স্বতন্ত্র সামন্ত গণ তাদের প্রভূ ইংরেজদের সহায়তায় আবারো জেলে পাঠায় মণি সিংহকে।

১৯৪০ এ ময়মনসিংহ জেলা কমিউনিস্ট এর সেক্রেটারী, ১৯৪৫ এ নেত্রকোনা’র নাগড়া তে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান, ১৯৪৬ এ ভারতের সাধারণ নির্বাচনে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে পার্টি’র হয়ে নির্বাচন করেন। ১৯৪৬-৪৭ এ তেভাগা আন্দোলনে রাখেন অসামান্য অবদান।

দেশভাগের পর আইয়ুব সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়েও মা-মাটির টানে রয়ে যান পূর্ব-পাকিস্থানে। পাকিস্থান সরকার মই চালায় উনার ভিটে’তে । উনার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। ১৯৪৮ এ জঙ্গী রুপে নামেন টঙ্ক প্রথা বন্ধ করতে। ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্থান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মণি সিংহ।
সন ১৯৫০ । ভীত পাকিস্থান সরকার তীব্র আন্দোলনের মুখে বিলুপ্ত করেন টংক প্রথা।চালু করে টাকায় খাজনা।কৃষকের জমি স্বত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। টংক আন্দোলনের বিভিন্ন সময় নারী-পূরুষ-শিশু সমেত প্রায় ৬০ জন বলীদান হন।

পাকিস্থান সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ পার্টি কমিউনিস্ট ও এর নেতা কমরেড মণিসিংহ কে ধরিয়ে দিতে ১০ হাজার টাকা পুরুস্কার ঘোষণা করে আইয়ুব সরকার। হুলিয়া মাথায় নিয়ে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত আত্মগোপনে থেকেও অব্যাহত রেখেছেন লড়াই-সংগ্রাম। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন।৫৪ এর প্রাদেশিক নির্বাচন। ৫৬ তে রাস্ট্র ভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায়ে, ১৯৬১ এর শিক্ষক আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন।
সন ১৯৬১। মাস পরন্ত নভেম্বর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজীব, কমরেড মণি সিংহ, কমরেড খোকা রায়, ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরি মিলিত হন ঢাকা’র মগবাজারের এক বাসায়। আলোচনা করেন দেশের চলমান রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে।নানা মত-পথে সংঘর্ষ ঘটার পরে একাধিক বৈঠকে ঐক্যমতে পৌঁছান নায়ক-মহানায়কণ।বিকশিত হয় পুস্প, শুরু হয় সংঘবদ্ধ আন্দোলন ছাত্র-জনতার। এই মিটিংকে বঙ্গের বোদ্ধা’গণ পরবর্তী’তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সেতু বলে আখ্যায়িত করেছেন।

১৯৬৭ সালে গ্রেফতার হন আত্মগোপনে থাকা মণি।১৯৬৯ এর ২২ শে ফেব্রুয়ারী ছাত্র-জনতার দাবীর প্রেক্ষীতে সকল বন্দি নেতাদের সঙ্গে মুক্তি দেওয়া হয় উনাকে ।কিন্তু অল্প কিছুদিনের মাথায় ৬৯ এর জুলাই মাসে আবার গ্রেফতার হন এই বিপ্লবী।

সন ১৯৭১। সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে নামেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। মণি সিংহ তখন রাজশাহী’র জেলে বন্দি। এপ্রিল মাসে কারাগার ভেঙ্গে মুক্ত করে কমরেড মণিসিংহ কে ভারতে পাঠায় বন্দিগণ। নির্বাচিত হন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অন্যতম উপদেস্টা হিসাবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থণ আদায়ে রাখেন অসামান্য ভূমিকা। বিশেষত রুশ সরকার-ভারত সরকারের সমর্থন আদায়ে। যুদ্ধে বিজয়ে’র মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে আত্ম প্রকাশ যুদ্ধ-বিদ্ধস্থ দেশ গঠনে রাখেন অবদান। এই সালেই মেটিয়াব্রুজের আন্দোলনের নায়ক কমরেড মণি সিংহ কে বাংলার প্রথম রেড ফ্লেগ এর প্রতিস্টাতা হিসাবে কলকাতায় শ্রমিকগণ সম্মানিত করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়ভাজন মণি দা, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু কে আমন্ত্রণ জানান বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির দ্বীতিয় কাউন্সিলে। প্রিয় মণি দা’র আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হন কাউন্সিলে। কাউন্সিলে তিনি নির্বাচিত হন সভাপতি হিসাবে । পরবর্তী তৃতীয় কাউন্সিলে ১৯৮০ সালে পুনরায় নির্বাচিত হন সভাপতি হিসাবে এবং ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে স্থায়ীছিলেন নিজ দলের প্রিয়ভাজন “বড়ভাই”।

সন ১৯৭৫, বঙ্গবন্ধু সূদূর প্রসারী চিন্তার প্রতিফলনে এক জাতীর ঐক্য সমুন্নত রাখতে এবং উন্নয়নশীল বাংলাদেশ গড়ার জন্য বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামীলীগঠন করেন। সেই দলেও মতানৈক্য শেষে সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নে বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন কমরেড মণি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন স্বপ্ন ভাঙ্গে তবুও হাল ছাড়েন নি বঙ্গবন্ধুর মণি দা।প্রতিবাদ করেন বঙ্গবন্ধু হত্যার। ১৯৮০ সালে জিয়া সরকার গ্রেফতার করে এই মহান বিপ্লবী কে, কমরেড ফরহাদ সহ। পরবর্তী’তে পার্টির দূর্বার আন্দোলনে মুক্ত হন “বড়ভাই”। চাঙ্গা করে তুলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন।কিন্তু বিধির বিধানে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ১৯৮৪ সালে’র ২৩ ফেব্রুয়ারী হন শয্যাশায়ী।মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ছিলেন শয্যাশায়ী।

সন ১৯৯০, ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখ সকাল ১০ টা ৫০ মিনিটে ঢাকা’য় নশ্বরদেহ ত্যাগে ঠাঁয় নেন অনন্ত-অসীমে বড়ভাই, হাজংদের বেটা, বঙ্গে লাল ঝান্ডার স্থাপক, কৃষক-শ্রমিক-মেননতী মানুষের মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, মুক্তিযুদ্ধের সফল সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর মণি দা।

বিভিন্ন সময়ে দেশ-জাতির কল্যানে অবদান এর স্বীকৃতি স্বরুপ বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালে মরোণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে এই প্রবাদ পূরুষকে।

উনার মৃত্যুর পর উনার স্মৃতি-রক্ষার্থে পার্টি ও তাঁর সন্তান ডাঃ দিবালোক সিংহ সুসং দুর্গাপুরে “মণি সিংহ স্মৃতি স্তম্ভ” স্থাপন করেন। সেখানে প্রতিবছর ২৮ জুলাই পালন করা জন্মবার্ষিকী ও ৩১ ডিসেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারী পর্যন্ত উনারা মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে আয়োজিত হয় “মণি মেলা”।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ জুলাই ২০০০ সালে এই বিপ্লবীর জন্মশতবার্ষীকিতে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, মণি সিংহের ত্যাগ, আদর্শ, সততা, নিষ্ঠা ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে পুনরুজ্জীবিত হউক । তিনি হয়ে উঠুক তরুণ বিপ্লবীদের আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎস।
আ-মৃত্যু যিনি ছিলেন শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। খেটে-খাওয়া কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের জন্য প্রাণের নেতা । আন্দোলনে কিশোর বয়সে’ই ব্রিটিশকে উচ্ছেদের জন্য সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল অনুশীলনের হাত ধরে যার বিপ্লবী জীবনের যাত্রা শুরু।মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের রাজনীতি, দর্শন ও আদর্শ যার অনুপ্রেরনা। দেশের স্বাধীনতা,গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আ-মৃত্যু যিনি লড়েছেন। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠাকল্পে আপোষহীন আন্দোলনে যাঁর অসামান্য অবদান অবিস্মরণীয়।ত্যাগের মহিমায় যিনি স-মুজ্জল। তিনি কালের যাত্রায় ,হালে হয়ে উঠেন অবহেলীত জন-মানুষের মুক্তির কান্ডারী কমরেড মনি সিংহ। ১১৬ তম জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ইতিহাসের মহানায়ক ।


(সিজিসি/এসপি/জুলাই ২৮, ২০১৭)