মাঈনুল ইসলাম নাসিম : প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় অর্থনৈতিক পরাশক্তির দৌড়ে জাপানের সাথে পাল্লা দেয়া দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বাংলাদেশি বৈধ জনশক্তি। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ‘টেকনিক্যাল ট্রেনিং এন্ড লেংগুয়েজ ইনস্টিটিউট’-এর অপ্রতুলতার কারণে কোরিয় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কোটা পূরণ করতে পারছে না বাংলাদেশ। ২৫ জুন বুধবার এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমনটাই জানালেন সিউলে দায়িত্বরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এনামুল কবির। প্রায় দু’বছর যাবত দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানীতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন তিনি।

পেশাদার কূটনীতিক এনামুল কবির এর আগে ভূটান, ভিয়েতনাম ও ফ্রান্সে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। সরকারী হিসেবে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার বাংলাদেশি কর্মরত আছেন বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়াতে। আরো অন্তঃত প্রায় হাজার দেড়েক আছেন অবৈধভাবে যারা বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে এলেও সময়মতো ফিরে না গিয়ে ‘লিগ্যাল স্ট্যাটাস’ হারিয়েছেন। নির্ধারিত মেয়াদে কাজের কন্ট্রাক্ট নিয়ে কোরিয়াতে আসার পর মেয়াদ শেষে বাংলাদেশে ফিরে গেলে কোরিয় সরকার তাদেরকে পুনরায় ‘জব ভিসা’ দেবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে বলে জানান রাষ্ট্রদূত এনামুল কবির।

বৈধভাবে যারা কোরিয়াতে বসবাস করছেন তাদের বেশির ভাগই কাজ করছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মাঝারি সব শিল্পকারখানায়। ইলেকট্রনিক্স, ফার্নিচার, টেক্সটাইল ও কটন প্রোডাকশন জগতে বাংলাদেশিদের বহুদিনের সুনাম দেশটিতে। থাকা-খাওয়া ফ্রি হবার সুবাদে তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশি টাকায় মাসে প্রায় ১ লাখের মতো সঞ্চয় করছেন। অর্থনৈতিক সংকটমুক্ত এই দেশটিতে সঙ্গত কারণেই সব মিলিয়ে ভালো আছেন পরিশ্রমী বাংলাদেশিরা। এমপ্লয়মেন্ট পারমিট সিস্টেম (ইপিএস)-এর আওতায় প্রতি বছর কোরিয় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কোটায় বিভিন্ন দেশে থেকে কর্মীরা আসেন এখানে।

বাংলাদেশের জন্য গেল বছর ৩ হাজারের কোটা নির্ধারিত থাকলেও তা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। রাষ্ট্রদূতের দেয়া তথ্য অনুযায়ি ২০১৩ সালে জব ভিসায় বাংলাদেশ থেকে কোরিয়াতে এসেছেন ২০৪৮ জন। আগের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ১৩৬৩। জনশক্তির ক্রমবর্ধমান এই ধারা অব্যাহত রাখতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন রাষ্ট্রদূত এনামুল কবির। নির্ধারিত কোটা পূরণ না হবার মূল প্রতিবন্ধকতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক স্টান্ডার্ডে কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রতুল এবং কোরিয় ভাষা যথাযথভাবে শেখার জন্য ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে আরো অনেক উন্নত মান সম্পন্ন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে।’’

উচ্চশিক্ষার জন্যও বাংলাদেশিদের কাছে কোরিয়া একটি আদর্শ দেশ। প্রায় সাড়ে ৬শ’ মেধাবী বাংলাদেশি বর্তমানে দেশটিতে আছেন, যারা ইতিমধ্যে কোরিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাফল্যের সাথে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন এবং ‘পোস্ট-ডক্টরাল’ পর্যায়ে গবেষণাধর্মী কাজে নিয়োজিত আছেন। ৩ থেকে ৪ হাজার ইউএস ডলারও বেতন পাচ্ছেন তাদের অনেকে। খুবই সীমিত সংখ্যক বাংলাদেশি ব্যবসা-বানিজ্যে নিজেদেরকে মেলে ধরেছেন দেশটিতে।

বাংলাদেশ-কোরিয়া দ্বিপাক্ষিক বানিজ্যিক সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রদূত এনামুল কবির। তিনি জানান, গত অর্থবছরে ৩৩২ মিলিয়ন ইউএস ডলারের পন্য বাংলাদেশ থেকে এসেছে কোরিয়াতে, যার মধ্যে রয়েছে আরএমজি তথা গার্মেন্টস পন্যসামগ্রী, হিমায়িত মাছ, চামড়া, ইলেকট্রিক তার, কিছু ফুড আইটেম এবং মেডিসিন। অন্যদিকে গত অর্থবছরে কোরিয়া থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ১৪২৭ মিলিয়ন তথা প্রায় দেড় বিলিয়ন ইউএস ডলারের পন্য। কোরিয় ইলেকট্রনিক চিপস ও গাড়ির পার্টসের বিশাল বাজার বাংলাদেশে।

টেলিকমিউনিকেশন, ইঞ্জিনিয়ারিং ও কনস্ট্রাকশন সেক্টরের কোরিয় টেকনোলজিকে গুরুত্বের সাথে কাজে লাগানো যেতে পারে বাংলাদেশের উন্নয়নে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৪শ’ কোরিয় প্রতিষ্ঠানের সরাসরি বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশে। রাষ্ট্রদূত এনামুল কবিরের ভাষ্য অনুযায়ি, পৃথিবীর যে কোন দেশেই বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে কোরিয় সরকার। সঙ্গত কারণেই যে কোন দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে বিনোয়াগ প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখে থাকে তারা।

উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের পাশ্ববর্তি দেশ মিয়ানমার ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করায় দেশটিতে ইদানিং ব্যাপকভাবে বাড়ছে কোরিয় ইনভেস্টমেন্ট। বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকলে বন্ধুরাষ্ট্র কোরিয়া থেকে ব্যাপক বিনিয়োগ নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মানে বিশেষ অগ্রগতি অর্জন সম্ভব বলে মনে করছেন বিশ্লেষক মহল।
(এএস/জুন ২৬, ২০১৪)