টিকটিকি ও মানিব্যাগ

এক
মিনু ও রনির মধ্যে ছলি বেশ ভাব। বয়সে দুজনেই পিঠাপিঠি। রোজ দুজনেই স্কুল থেকে এসে খেলতে বসে। গাড়ি খেলা, চোর-পুলিশ খেলা, পলান-চোর খেলা, কাগজের নৌকা খেলা, রাজা-রানি খেলা প্রভৃতি সকল খেলাতেই তাদের তাদের বেশ দখল রয়েছে। কোন এক বিকেলে চোর-পুলিশ খেলতে গিয়ে রনি জ্ঞাতসারেই মিনুকে বেশ জোরে মেরে দিল। মার খেয়ে মিনুর সেকি কান্না! পাশের রুম থেকে মা সেলিনা দৌঁড়ে এল। সকল ঘটনা শুনে রনিকে আচ্ছা রকম বকে দিল। কিন্তু মিনুর কান্না তো আর কোনক্রমেই থামছে না। সেলিনা বেগম বুঝতে পারলেন মিনু বিচারে সন্তুষ্ট নয়। আরও বেশি কিছু চায়। কাজেই মিনুকে খুশি করার জন্য তিনি রনিকে একটু কানমলাও দিলেন। ছোট্ট রনি কিন্তু এতে খুব অপমান বোধ করলো। সেও ম্যা ম্যা করে কাঁদতে কাঁদতে মিনুর রুমে ঢুকলো। ওর একটা ভারী বাজে অভ্যাস ছিল। রাগ ওঠলে সামনে যা পায় তা সে ছুড়ে মারে। সেলিনা বেগম ভাবলো হয়ত কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে।

মিনুকে নিয়ে তিনি পাশের বাসায় গেলেন। এদিকে মিনুর পড়ার টেবিলের একপাশে রাখা ছিল সিডি প্লেয়ার। ৪র্থ শ্রেণিতে প্রথম হওয়ায় কবির মামা তাকে কিনে দিয়েছে। গতকালই মাত্র এনেছে। দেখতে বেশ চকচকে। রনি প্রথমে সেটাকে ছুড়ে মারলো। নিচে টাইলসের মাঝে পড়তেই তা কয়েক টুকরো হয়ে গেল। তারপরে ধরল মিনুর বই, খাতা, জামা ইত্যাদি। টেবিলের একপাশে রাখা ছিল কবির মামার মানিব্যাগ। মানিব্যাগে তিনি সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস রাখেন। সপ্তাহ খানেক হবে সে আমেরিকা থেকে দেশে এসেছেন। কিছুদিন থেকে আবারও সে চলে যাবে। পাসপোর্ট, গ্রীনকার্ড, অফিসের পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সে মানিব্যাগেই রাখতো। আজ কী কারণে যেন সে মানিব্যাগটি নিয়ে যায় নি।

রনি মানিব্যাগটি ধরে বাহিরে ছুড়ে মারলো। দরজার সামনেই জিহ্বা বের করে বসা ছিল পাশের বাড়ির ‘টমি’ কুকুর। নিজের মুখের সামনে মানিব্যাগটি পড়ামাত্রই কুকুরটি কামড়ে ধরলো। হয়ত মাংস বা হাড় জাতীয় কিছু একটাই সে মনে করেছে! আরাম করে খাবে এমনটি ভেবে একটু আড়ালে নিয়ে গেল। রনি একবার কুকুরটির দিকে তাকাল। কিন্তু কিছুই বলল না। এরপর দেখতে দেখতেই কুকুরটি মানিব্যাগসহ অদৃশ্য হয়ে গেল।

দুই
সন্ধ্যেবেলা। কবির মামা রুমে ঢুকতেই দেখল রুম লন্ডভ-। ঝড়ে গৃহের যেমন অবস্থা হয় তেমনি আর কি! হন্যে হয়ে তিনি তার মানিব্যাগ খোঁজতে লাগলেন। রুমের জ্ঞাত অজ্ঞাত সকল জায়গাতেই খোঁজলেন। কিন্তু কোথাও পেলেন না। রাগে তিনি অস্থির হয়ে ওঠলেন। তার চোখ-মুখ ক্রমশই লাল হয়ে ওঠছে। মিনিটের মধ্যেই তার বাঁজখাই কণ্ঠে সমস্ত বাড়ি তোলপাড় করে তুললেন। তার গলাবাজিতে বাসার ছোটবড় সকলেই হাজির হল। কেউ কবিরের চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। কেননা, মাদকসেবীদের মতোই এখন কবিরের চোখও রক্তবর্ণ। লোহা ঝালাইয়ের সময় তা থেকে বের হওয়া স্ফুলিঙ্গের মতো কবিরের চোখের কোঠর থেকেও যেন অগ্নি স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে! একে একে সকলেই খোঁজতে লাগলেন। কিন্তু কেউ মানিব্যাগের কোন সন্ধান পেলেন না।

খোঁজতে খোঁজতে সেলিনা বেগম যতই হয়রান হচ্ছে ততই তার রাগের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। শেষটায় সে লাঠি হাতে নিল। আজকের ঘটনার মূল হোতা যে রনি তা বুঝতে মোটেও বাকী ছিল না সেলিনার। কাজেই তাকে উত্তম-মধ্যম কিছু দিলে সব ঘটনাই বের হয়ে যাবে। আজ আর তার রক্ষে নেই। শাসন না করতে করতে সে বেশি বেড়ে গেছে। সেলিনার স্বামী ওয়াজেদ আলীও তাকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেয়। ছেলেকে আজ শাস্তি না দিলেই নয়। রনির দাদা গণি মুনশি কবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। কেবল সাহস করে আমেনা দাদিই শুধু এইটুকু বলল- ছাওয়ালটারে না মারি বুঝায়ে বললি কাজ হতি পারে। হয়ত বুঝায়ে বললে অনেক সময়ই কাজ হয় কিন্তু আজ যে বুঝায়ে বলার দিন নয়। পাসপোর্ট, গ্রীনকার্ড আরও কত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস! ওগুলো না পেলে যে ছোট ভাইটার আমেরিকা যাওয়াই একেবারে কানা হয়ে যাবে!

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রনি সবই দেখছে। মামার রাগ দেখে ভয়ে সে একেবারে পা-ুবর্ণ হয়ে গেল। মামার এই ভয়ানক রূপ সে ইতোপূর্বে কখনোই দেখে নি। কোনক্রমে যদি মামা জানতে পারে যে সে-ই এ কাজ করেছে কিংবা তার মাধ্যমেই এটা হারিয়েছে, তাহলে কিন্তু আজ তার আর রক্ষে নেই। রনির পাশেই দেয়ালের গায়ে ছিল এক টিকটিকি। প্রায় সময়ই সে এই টিকটিকির সাথে খেলত। টিকটিকির সাথে তার বন্ধুত্বের স¤পর্ক ছিল বেশ অদ্ভুত রকমের। সে হাত বাড়ালেই টিকটিকি তার হাতের তালুতে ওঠে আসতো। দুজনে কথা বলতো। টিকটিকীয় ভাষা! কখনো বা টিকটিকির মাথায় আলদো চুম্বন দিত। আদর পেয়ে টিকটিকি চোখ বন্ধ করতো। শুধু তাইই নয় ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ প্রভুভক্ত কুকুরের মতো সেও তার লেজ নাড়াত। কখনো বা চোখ পিটপিট করে টিকটিক করে ডেকে ওঠতো। এসব অদ্ভুত ঘটনার একমাত্র রাজসাক্ষী হল মিনু।

তিন
আজ এই বিপদের দিনে সে টিকটিকিকে বলল- বন্ধু, আমার আজকে খুব বিপদ। আমাকে একটু বাঁচাও না। কথা দিচ্ছি আর দুষ্টুমি করবো না। টিকটিকি একবার চোখ নাড়ল। তার চোখ নাড়াতে মনে হল সে রনির প্রতিজ্ঞাকে বিশ্বাস করেছে। তাছাড়া টিকটিকিকেও সে নানা ভাবে সহযোগিতা করেছে। তাই কৃতজ্ঞ চিত্তে সে একবার টিকটিক করে ওঠলো। পাশেই ছিল হুলো বিড়াল। টিকটিক শব্দ শুনতেই সে ম্যাঁও ম্যাঁও করে খাবার জন্য এগিয়ে গেল। এই বুঝি সে কামড় মেরে খেয়ে ফেলবে! পরিমরি করে টিকটিকি দিল দৌঁড়। জানালা দিয়ে বের হয়ে একেবারে বাতরুমের পাশে সরু গলির মুখে এক কালো ব্যাগের মধ্যে! বিড়াল পাশ দিয়েই রাজকীয়ভাবে ঘুরছে। কিন্তু হুট করে যে এই টিকটিকির বাচ্চা তার চোখ ফাঁকি দিয়ে কোথায় লুকালো তা যেন সে ভেবেই পাচ্ছে না! রনি দৌঁড়ে এল প্রিয় বন্ধু টিকটিকিকে বাঁচাতে। রুম থেকে তার দৌঁড়ে বেরিয়ে যাওয়া দেখে পিছন দিক থেকে তার মা লাঠি হাতে সুউচ্চ স্বরে ডাকছে- রনি! রনি!! দাঁড়া বলছি। আজকে তোর…!

রনির দৃষ্টি তখন টিকটিকির দিকে। সে ঠিকই খোঁজে পেল টিকটিকিকে। মশা যেমন করে মানুষকে খোঁজে বের করতে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না, তেমনি রনিরও টিকটিকিকে খোঁজে বের করতে কষ্ট হয় নি। বাতরুমের পাশে সরু গলির মুখে রাখা এক কালো মানিব্যাগের চিপার মধ্যে সে চুপচাপ লুকিয়ে রয়েছে। কেউ আসছে বুঝতে পেরেই টিকটিকির বুকটা ধরফর করতে লাগলো। সে মনে করল আর বুঝি রক্ষে নেই। তবুও একটিবার মাথা বের করে দেখল কে আসছে। রনিকে দেখেই সে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সেই সাথে মহা খুশিতে সে টিকটিক করে ওঠলো। টিকটিক শব্দ শুনে সে মানিব্যাগটি হাতে নিল। পাসপোর্ট ও গ্রীনকার্ডের চিপার মধ্যে থেকে সে একবার চোখ পিটপিট করে ডেকে পুনরায় ডেকে ওঠলো- টিক টিক টিক।