মেহেরপুর প্রতিনিধি : মেহেরপুরে সমবায় সমিতির নামে আমানত রাখা প্রায় ২৯ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে ৬টি সমিতির পরিচালক। সম্প্রতি এ তালিকায় যোগ হয়েছে জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের আরও একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানেও প্রায় ৪ কোটি টাকা আমানত রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের।

রাতারাতি লাপাত্তা হওয়ায় জেলার কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ তাদের আমানতের অর্থ হারিয়ে এখন নিঃস্ব প্রায়। অর্থ ফেরত পেতে আদালতসহ বিভিন্ন দফতরে ঘুরছেন অনেকে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন সমবায় সমিতির আইন না মানার কারণে এধরনের ঘটনা বেড়েই চলেছে।

২০০৪ সাল থেকে মেহেরপুরে বিভিন্ন নামে সমবায় সমিতি খুলে আমানত সংগ্রহ শুরু করে প্রতারক চক্র। আইডিয়াল কো-অপারেটিভ, এভারগ্রীন কো-অপারেটিভ সমবায় সমিতি, বাদিয়াপাড়া, জনতা, সততা, আলবারাকা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নামে বড় বড় সাইনবোর্ড টানিয়ে অফিস খুলে বসেন তারা।

ব্যাংক যেখানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ মুনাফা দেয় সেখানে এসব প্রতিষ্ঠান ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মুনাফা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। বেশি মুনাফার আশায় হাজার হাজার মানুষ তাদের অর্থ আমানত হিসেবে জমা রাখে ওইসব প্রতিষ্ঠানে। সমবায় সমিতির আইন অমান্য করে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান জেলা ও জেলার বাইরেও একাধিক শাখা খুলে বসে। অথচ আইনের ২৩ এর (ক) ধারায় বলা হয়েছে কোনো সমবায় সমিতি তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোনো শাখা অফিস খুলতে পারবে না।

আবার কেন্দ্রীয় সমিতি বা জাতীয় সমবায় সমিতির সঙ্গে ব্যাংক শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশনা থাকলেও কোনো কোনো সমিতি তাদের নামের সঙ্গে ব্যাংক শব্দও ব্যবহার করে। এসব আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় গেল ১০ বছরে মেহেরপুর জেলায় ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠে ২২টি সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সাধারণ মানুষকে ঋণও প্রদান করা হয়। যা সমবায়নীতির পরিপন্থি। এখনও ১৮টি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ মানুষের আমানত জমা রয়েছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা। আর ২৯ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে ৬টি প্রতিষ্ঠানের প্রতারক। অনেকেই তাদের টাকা ফিরে পেতে ঘুরছেন আদালতসহ বিভিন্ন দফতরে।

সম্প্রতি এ তালিকায় যোগ হয়েছে জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান দান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামের আরও একটি প্রতিষ্ঠান। জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৭ শতাধিক গ্রাহক প্রতিদিন জেলা শহরের হোটেলবাজার পুরাতন পোস্ট অফিস মোড়ের অফিসটিতে এবং গাংনী অফিসে আসছে আর ফিরে যাচ্ছে। যোগাযোগের জন্য প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে কর্মরত ম্যানেজার মো. লালচাঁদ আলী সুমনসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মকর্তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। জেলা সমবায় কর্মকর্তা গ্রাহকদের থানায় জিডি অথবা আদালতে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন।

জেলা সমবায় অফিসসূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি চাকরিবিধি লংঘণ করে কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। মেহেরপুর অফিসটি ব্যবস্থাপক হিসেবে মো. লালচাঁদ আলী সুমন নামের একজন এটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রতিষ্ঠানটির জেলা সদরে গ্রাহকসংখ্যা সমবায় সমিতির পরিদর্শকের তদন্তে অডিট নোটে ৪১৮ আবার সভ্য রেজিস্ট্রারে ৬৩২ দেখতে পেয়েছেন। গাংনীর অফিসেও সঠিক সদস্য সংখ্যার পরিসংখ্যান খুঁজে পাননি পরিদর্শক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার খন্দকার আবুল কালাম আজাদ নামের এক ব্যক্তি ২০১৩ সালে মেহেরপুর, তার আগে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, পাবনা, রাজশাহী, ঈশ্বরদি, মাগুরা, ঝিনাইদহ, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলায় জেলা সদর ও জেলার উপজেলা পর্যায়ে ‘জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেন। জেলা সদরে ও উপজেলা পর্যায়ে শহরের দৃষ্টিকাড়া স্থানে নামি দামি বাড়ি ভাড়া নিয়ে চাকচিক্য করে অফিস খুলে বসে।

সহজ শর্তে ব্যবসায়ীদের জন্য মোটা ও প্রান্তিক মানুষের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণের কার্যক্রম শুরু করে। গ্রাহকগণ তফশিলি ব্যাংক মনে করে তাদের আমানত এখানে গচ্ছিত রাখতে শুরু করেন। অনেক ব্যবসায়ীকে প্রতিষ্ঠানটি মোটা অংকের ঋণ প্রদান কারার কারণে শহরের ব্যবসায়ীরা ঝুঁকে পড়েছিল ওই প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু ঈদুল ফিতরের ছুটিতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা গিয়ে আর ফিরে আসেনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে মেহেরপুরের মতো প্রতিটি জেলা ও উপজেলা থেকেও অফিস গুটিয়ে নেয়া হয়েছে।

জেলা সমবায় অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে ঢাকা থেকে ‘জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে নিবন্ধন লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। পরে বিভিন্ন জেলায় জেলা সমবায় অফিস থেকে সেই জেলায় কার্যক্রমে নিবন্ধিত হয়।

মেহেরপুর জেলা শহরের পুরাতন পোস্ট অফিস মোড়ে আওয়াল হোসেনের বাড়ির দ্বিতীয় তলা ভাড়া নিয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। যার সভাপতি হলেন মো. আবুল হাসেম ও সম্পাদক মো. নাহারুল ইসলাম।

সমিতির গ্রাহকদের মাঝে ঋণ দেয়া আছে প্রায় ৩২ লাখ টাকা। গ্রাহকদের সঞ্চয়-আমানত আছে প্রায় ৪ কোটি। মেহেরপুর জেলা সমবায় সমিতির হিসাব মতে প্রতিষ্ঠানটির সোনালী ব্যাংক মেহেরপুরে প্রধান শাখায় মাত্র ৩ হাজার ৪০০ টাকা জমা রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেয়াদী চুক্তি আমানতে (ডিপোজিট) ১৮% – ২৪% হারে মুনাফা দেওয়ার কথা। গ্রাহকদের মধ্যে কায়েম উদ্দীন খাঁন, গোলাম কাউসার, আবদুল মজিদ, মো. বাসেদ, আরিফুলইসলাম, আলেয়া খাতুন, পারুল বেগম, ইসমাইল হোসেন, আবুল বাশার মিন্টু, রাকিব, মিসেস রানা, সুশান্ত, রাব্বিসহ শতাধিক ব্যক্তি জেলা সমবায় অফিসে সমিতির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে তাদের টাকা আদায়র ব্যবস্থা নেবার জন্য আবেদন করেছেন। গ্রাহকগণ জেলা সমবায় অফিসের দেখভাল না থাকার কারণেই গ্রাহকদের সঞ্চয়ের টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

জেলা সমবায় অফিসের পরিদর্শক মো. মাহবুবুল হক জানান, প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা থেকে কার্যক্রমের অনুমতি গ্রহণ করে। ফলে জেলা সমবায় অফিসের কিছু করণীয় না থাকলেও গ্রাহকদের পরামর্শ দেয়া হয় এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন না করার। তারপরও মোটা লাভের আশায় লোকজন লেনদেন করে প্রতারিত হচ্ছেন।

সমবায় সমিতির নিয়মানুযায়ী শেয়ার ক্রয় করা গ্রাহককে বছর শেষে শেয়ারের লভ্যাংশ না দেওয়া, টাকা উত্তোলনের জন্য চেক বই ইস্যু করা ও সঞ্চয় কিংবা নগদ টাকা জমাদানের জন্য আলাদা রশিদ বই, বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ব্যাংকের আদলে ডিএসপি, ডিপোজিট সিস্টেমসহ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা এবং ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির অনুমোদন না নিয়েই ক্ষদ্র ঋণের মতো কার্যক্রমসহ ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে স্বাক্ষরসহ ফাঁকা চেক ও স্ট্যাম্প রাখার অভিযোগ উঠেছে।

জেলা সমবায় কর্মকর্তা কাজী মিজানুর রহমান জানান, অবৈধভাবে কার্যক্রম চালানো সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবেন। বিষয়টি তিনি বিভাগীয় সমবায় অফিসকে অবহিত করেছেন। পালিয়ে যাওয়া প্রতারকদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি সমবায় অফিস।

অর্থনীতিবিদ ড. মো. ইনাম হোসেন জানান, সমবায় সমিতি কোনো মালিকানাধিন প্রতিষ্ঠান নয়। অথচ মালিক সেজে প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং সমবায় আইন না মানার কারণে জনগণের টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কঠোর হবার পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্টদের।

মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ জানান, যারা পালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চলমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে নজরদারির মধ্যে রাখা হবে এবং তাদের কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে আইনের মাধ্যমে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।

(ওএস/এসপি/আগস্ট ১০, ২০১৭)