মোহাম্মদ নেয়ামত উল্লাহ, নারায়ণগঞ্জ : উচ্চ আদালতে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন মামলার রায় আগামীকাল রবিবার। নিম্ন আদালতের দেয়া রায়ের কিরুদ্ধে দাখিল করা আপিলের সিদ্ধান্ত জানা যাবে ১৩ আগস্ট রবিবার। এর আগে ৭ খুনের মামলায় নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রধান আসামী নূর হোসেন, র‌্যাবের ৩ জন কর্মকর্তা সহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও বাকি ৯জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে ১৩ আগস্ট রায় ঘোষণার দিন ধার্য্য করা হয়।

তবে ১৪ আগস্টও হাইকোর্ট এর আগে গত ১৬ জানুয়ারী দেওয়া নিম্ন আদালত বহাল রাখবে এমন প্রত্যাশা নিহত পরিবার ও স্বজনদের। তাঁরা বলছেন, তাদের প্রতাশ্যা শুধু হাইকোর্ট রায় বহাল না সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত রায় কার্যকর করা।

সাত খুনে নিহতেরা হলো, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, সহযোগী সিরাজুল ইসলাম লিটন, তাজুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান স্বপন ও গাড়ি চালক জাহাঙ্গীর এবং জৈষ্ঠ্য আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ি চালক ইব্রাহিম।

সাত খুনে নিহত নজরুল ইসলামের গাড়ী চালক জাহাঙ্গীরের স্ত্রী সামছুন্নাহার নুপুর বলেন, ঘটনার মাত্র ১০ মাস আগে আমাদের বিয়ে হয়। তার ২ মাস চারদিন পর একমাত্র মেয়ে রোজা জন্মগ্রহণ করে। এর মধ্যে নির্মম ভাবে আমার স্বামীকে হত্যা করে। আমি তাদের ফাঁসি বহাল চাই।

তিনি আরো বলেন, ‘মেয়র আইভী আপা (নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী) তখন আমাকে সিটি করপোরেশনের সিদ্ধিরগঞ্জ অঞ্চলে চাকুরি দেয়। সেই চাকুরি বেতন দিয়ে সংসার চলে। এখন রোজার ৩ বছর শেষ হয়েছে। আগামীতে স্কুলে ভর্তি করতে হবে। আমরা জীবন যেভাবে খুশি চলে যাচ্ছে কিন্তু মেয়েকে নিয়ে ভাবলেই ভয় হয়। আমার ভাসুরদের (জাহাঙ্গীরের বড় দুই ভাইকে) বাবা বলে ডাকে। যখন কেউ ধমক দেয় বলে তোর বাবা নেই। তখন কোন ভাবেই ওরে বুঝাতে পারি না যে ওর বাবা মারা গেছে। আর কোন দিনও ফিরে আসবো না।’ কথাগুলো বলেই কান্না করনে নুপুর।

নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের বলেন, ছেলেকে আর ফিরে পাবো না। কিন্তু যারা আমার ছেলে সহ সাতজনকে মেরেছে তাদের যেন ফাঁসি দেখে যেতে পারি। উচ্চ আদালতেও যেন তাদের ফাঁসি বহাল থাকে। এটাই আলøাহর কাছে প্রার্থনা করি।

নিহত কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, যারা মেরেছে তাদের সঠিক বিচার দাবি করছি। এটা রাজনীতির প্রতিহিংসার ছিল অনেক আগে থেকেই ও এক সময় বিএনপি করতো জামাত করতো সে থেকে আওয়ামীলীগে এসেছে। সে কারো কাজেই কখনো বাধা দেয়নি সে নিজের মত কাজ করতো। সে নিজের ব্যবসায় যায়নি কখনো। সে সর্বশেষ ১ টা ৪৫ এ হত্যার দিন কথা হয়, আদালতের কাজ শেষ আমাকে বলে আমি যাচ্ছি যাত্রাবাড়ি। সেদিন ঢাকায় নূর হোসেনের একটি মিথ্যা মামলায় জামিনের জন্য এখানে এসেছিল। এর আগে প্রায় কঠোর একটি মিথ্যা মামলায় সে ঢাকায় প্রায় মাসখানেক থাকে। আমি সেই কথা বলে গোসল করতে যাই, এসে দেখি আমার মোবাইলে বিভিন্ন মানুষের ফোন পরে তারা জানায় যে ভাইয়ের ফোন বন্ধ, তার সাথে যারা ছিলো সবার মোবাইল বন্ধ। তারপরই তো সবার দৌড়াদৌড়ি। এখন আমার প্রত্যাশা যে রায় হয়েছে সেটিই যেন বহাল থাকে। প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে বলেছেন যারা হত্যার সাথে জড়িত সবারই বিচার হবে। আগে কিছুটা প্রেসার ছিলো এখন সবকিছু সঠিক।

আমি বাড়িভাড়া দিয়েই আপাতত চলি, বড় ছেলেকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়েছে। উপরে থেকে অনেকেই বলে হাইকোর্ট থেকে তারা কিছুএকটা পেয়ে যাবে। আমি আশায় আছি ১৩ তারিখের। দেখি সেদিন কি হয়। আমার একটি দাবি নূর হোসেনের যেই অবৈধ সম্পদ রয়েছে, যেসব অসহায় মানুষ রয়েছে তাদের কাছে যেন এসব বিলিয়ে দেয়া হয়। কারণ এখানে অনেকের সম্পদও রয়েছে। এখানে অনেকে রয়েছে তাজুলের পরিবারও। অনেকের কর্মসংস্থানও যেন করা হয় তাদের পরিবার এ হত্যায় অসহায় অবস্থায় রয়েছে।
নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেন, আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আমরা চাই উচ্চ আদালতেও যাতে রায়টি বহাল থাকে এবং রায়টি দ্রæত কার্যকর হয়।

প্রসঙ্গত, নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার প্রধান আসামী নূর হোসেন, র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা ও মেজর আরিফ হোসেনসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। বাকি ৯ জনকে সাত থেকে ১০ বছরের কারাদÐ দেওয়া হয়েছে। ১৬জানুয়ারী সোমবার সকাল ১০টা ৪মিনিট হতে ১০টা ৯ মিনিট পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন ওই রায় ঘোষণা করেন। আসামীদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় এ রায় দিয়েছেন আদালত।

নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস তো বটেই দেশের ইতিহাসে ন্যাক্কারজনক ঘটনার একটি। কলংক এটে দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জবাসীর ললাটে। প্রমাণ সহ মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এলিট ফোর্স র‌্যাব। ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল অপহরণের সেই ঘটনা এখনো ভুলতে পারেনি রাজধানী লগোয়া শীতলক্ষ্যার তীরের মানুষ। ঘটনার পর র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার, প্রধান আসামী নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা সহ টান টান উত্তেজনায় পার হয়ে গেছে পৌনে তিন বছর।

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ২৬ জন

মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হলো গ্রেপ্তার থাকা প্রধান আসামী নূর হোসেন, র‌্যাবের চাকুরীচ্যুত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মাসুদ রানা (এমএম রানা), হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব, কনস্টেবল মো: শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দ বালা, র‌্যাবের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল। পলাতক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো নূর হোসেনের সহযোগি সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান, জামালউদ্দিন, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, আলামিন শরিফ, তাজুল ইসলাম, এনামুল কবীর। এসব আসামীদের বিরুদ্ধে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

৯ জনের কারাদণ্ড


অপহরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে করপোরাল রুহুল আমিনের ১০ বছর, এএসআই বজলুর রহমানের ৭ বছর, হাবিলদার নাসির উদ্দিনের ৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদের ১০ বছর, সৈনিক নুরুজ্জামানের ১০ বছর, কনস্টেবল বাবুল হাসানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, কামাল হোসেনের ১০ বছর ও মোখলেসুর রহমানের ১০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে অপহরণ করা হয়। একই সময়ে একই স্থানে আরেকটি গাড়িতে থাকা নারায়ণগঞ্জ আদালতের প্রবীণ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার চালককে অপহরণ করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর বন্দর উপজেলা শান্তির চর এলাকায় শীতলক্ষ্যা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সাত জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রত্যেকের পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন; প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল।


(এমএনইউ/এসপি/আগস্ট ১১, ২০১৭)