চৌধুরী আবদুল হান্নান


আগস্ট মাস বার বার ফিরে আসে এক গভীর বেদনা নিয়ে, আক্ষেপ আর কান্না নিয়ে। বাঙালি জাতির জন্য এ এক অনন্তকালের কান্না। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নৃশংস হত্যার মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সূচনা হয়েছিল এক কালো অধ্যায়। ইতিহাসের এ ঘৃন্য ও নৃশংস হত্যাকান্ডের দুর্বিষহ স্মৃতি অনন্তকাল বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের; বাঙালির চিরদিন বহন করে বেড়ানো এক দুঃখ।

দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব, ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নিলো স্বাধীন একটি দেশ, বাংলাদেশ। বিরল ও বিস্ময়কর দূরদর্শিতা দিয়ে দেশকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি। দেশবাসীকে অবশ্যম্ভাবী ক্রীতদাসে পরিণত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে সূর্য উদিত হয়েছিল তা স্বাধীনতার সূর্য। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনন্য অবদানও আমাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখতে হবে। পৃথিবীর বুকে আমরা এখন এক মর্যাদাশীল স্বাধীন জাতি।

যার কল্যানে আমাদের স্বাধীনতা তাকেই সপরিবারে হত্যা করলো এক দল বিপদগামী সেনা সদস্য; বাংলর কু-সন্তান। আন্তর্জাতিক শত্রুরা বাংলাদেশের জন্মকে মেনে নিতে পারেনি এবং তারাই খুনিদের এ বর্বর কাজে ব্যবহার করেছে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার নিজের কিছু লোকও বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিল। তিনি তাঁর লোকদের ওপর অগাধ আস্থা রাখতেন। সবসময় বলতেন, বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারবে না। তিনি ছিলেন নির্ভীক মানুষ, ক্ষমাশীল ও উদারতার কোনো সীমা ছিল না তাঁর। তিনি স্বাধীনতা এনে দিলেন কিন্তু দেশ গড়ার সময় দেওয়া হয়নি তাঁকে।

বঙ্গবন্ধুর সারা জীবন কেটে গেছে অন্যায়, অবিচারের প্রতিবাদ করে। পদে পদে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অন্যায়, জুলুম দেখলেই তিনি বই-পুস্তক তুলে রেখে, প্রতিকারে নেমে পড়েছেন। তিনি নিজে পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন না, কিন্তু তিনি যে কীর্তি, দর্শন সৃষ্টি করে গেছেন যা অধ্যায়ন করে, গবেষণা করে যুগে যুগে বুদ্ধিজীবী, পন্ডিত সৃষ্টির বিশাল এক ক্ষেত্র তৈরী হয়ে আছে।

বিগত প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে অগ্রযাত্রার সহায়ক ঘোষণাগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণাও স্থান পেয়েছে। যদিও ওই ভাষণটিতে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আসলে এটি তার সমকালীন বিশ্বে সব নিপীড়িত জাতিরই মুক্তি সংগ্রামের দিক নির্দেশনা। ভাষণটিতে ফুটে উঠেছে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা।

বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ‘নিউজ উইক’ ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল সংখ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে ‘রাজনীতির কবি’ (ঢ়ড়বঃ ড়ভ ঢ়ড়ষরঃরপং) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বজনীনতা এখানেই তাঁর স্থান নির্দিষ্ট হয়ে গেছে ইতিহাসে।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারী দিল্লির বিড়লা হাউজে সান্ধ্য-প্রার্থনা সভায় ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু গান্ধীজীর মৃত্যু সংবাদ বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন এই বলে যে, ‘আমাদের জীবনের আলো নিভে গেছে’। গান্ধীজী নেই, কিন্তু তাঁর মানবতাবোধ, অহিংসা নীতি এখনো আলো দিয়ে যাচ্ছে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর চেতনা, আদর্শ, আমাদের বর্তমান এবং আগামীর দিক নির্দেশনা, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যা কথনও নির্বাপিত হবে না।

বাঙালি জাতির এক সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাধা করার দায়িত্ব এসে পড়েছে তারই জেষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনার ওপর। দেশকে সফলভাবে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। জাতির পিতা হত্যার বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে এবং দন্ডিতদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে; ক্ষতিগ্রস্ত শহীদ পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নটি সামনে এসেছে। দন্ডিতদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা বেশি প্রয়োজন এই কারণে যে, ওরা অপরাধ সংঘটনের পরবর্তী সময়ে বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছে, যা তারা ব্যবহার করছে বাংলাদেশেরই বিরুদ্ধে।

বর্তমান প্রেক্ষিতে বলা যায়, দেশে দায়হীনতার কাল শেষ হয়েছে, আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার পথ সুগম হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার শপথ নেওয়ার মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার মধ্যেই রয়েছে জাতির পিতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার