কাজী আনিছ


শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের এক বক্তব্য শুনেছিলাম। তিনি বলেছেন, ‌' যে শিক্ষককে আমরা ভুলে যাই তিনি শিক্ষক। আর যে শিক্ষককে আমরা মনে রাখি তিনি গুরু।'

জীবনের স্বল্প অভিজ্ঞতা ও বর্তমান হালচালের নিরিখে বিচার করলে দেখি, স্যার কথাটি ভুল বলেছেন। এখন আমরা সেই শিক্ষককে মনে রাখি ও মনে করি যিনি ক্ষমতাবান।

শিক্ষকতার ‌'গুরু'ত্ব এখন নেই, আছে ক্ষমতা। যে শিক্ষকের ক্ষমতা আছে, তিনি শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে থাকেন, ব্যানারে থাকেন, পোস্টারে থাকেন, দেয়ালে থাকেন। যার নেই, তিনি কোনো কিছুতেই নেই। তাই শিক্ষার্থীদের মনে সারাজীবন জায়গা করে নেওয়ার জন্য শুধু শিক্ষকতার মুন্সিয়ানা দেখানো যথেষ্ট নয়, দরকার ক্ষমতা।

ক্ষমতা থাকলেই দেখবেন, আপনার শিক্ষার্থীরা আপনার বার্থডে উপলক্ষে হাজার হাজার কোটি কোটি ফুল নিয়ে হাজির হয়েছে। ফেসবুক ভরে গেছে উইশে। শুধু তা-ই নয়, আপনি পায়ের গোড়ালিতে ব্যথা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গিয়েছেন। দেখবেন, আপনার শিক্ষার্থীরা 'স্যারের গোড়ালি ব্যথা উপশমের জন্য দোয়া মাহফিল'-এ ব্যানারে এক বিরাট আয়োজন করে ফেলেছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী মোনাজাতে সেই যে অঝোর ধারায় কান্নাকাটি করবে যে, স্বয়ং ঈশ্বর মনে মনে বলবেন, 'এমন জানলে তো তোমাদের স্যাররে গোড়ালিই দিতাম না।'

কোন ভাইয়ের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কোন ভাবী অ্যাকসেপ্ট করেছে-এ নিয়ে একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। ক্ষমতাবান শিক্ষক যদি ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলে, শিক্ষার্থীরা সেই ছবিকেও ছাড়িয়ে যাবে। 'ফেসবুকের এক বিরাট মাইলফলক', 'স্যার ফেসবুকে ছিল না, কেমন জানি মরা মরা লাগতো।' ‌-শিক্ষার্থীদের এমন উচ্ছ্বাসে ভরে যাবে ফেসবুক। এখানেই শেষ নয়, এ উপলক্ষে কনসার্টের আয়োজন হতো। শিল্পী জেমস গলা ছেড়ে গাইতো, 'পাগলা হাওয়ার তোড়ে, মাটির পিদিম নিভু নিভু করে, ওরে ওরে হাওয়া থামনারে, স্যারের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দেখভার দেছনা রে...হই...হই।' বাচ্চু গাইতেন, 'লাইক চাইলে লাইক পাবে, লাভ চাইলে লাভ, সবই হবে অগোপনে, স্যার আমাদের বাপ।' মমতাজ তো সেদিন জাকারবার্গ নিয়ে গাওয়া শুরু করে দেবে, 'পোলা তো নয়, সে তো আগুনেরই গোলারে।'

ক্ষমতা নেই শিক্ষার্থীদের ভালবাসাও নেই। স্মরণও নেই। আমি কখনও আমার প্রিয় শামসুল মজিদ হারুন স্যার কেমন আছে জানতে চাইনি। জানতে চাইনি, এখন স্যার কীভাবে দিন কাটাচ্ছেন। কখনও আমি আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী স্যারের বার্থডেতে দল বেঁধে গিয়ে উইশ করিনি। ফেসবুকে একটা ছবি দেইনি। কখনও একবার জিজ্ঞেস করিনি, 'স্যার কেমন আছেন।' জানতে চাইনি কেমন আছেন মান্নান স্যার। প্রিয় মাহফুজুল হক খান স্যার দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেল। জীবিত অবস্থায় তো নয়ই, মৃত্যুর পর একটু স্মরণ করার চেষ্টাটুকুও করিনি। এমন অনেক শিক্ষকের কথা মনে নেই। কিছু মনে নেই। স্মরণে নেই।

প্রিয় স্যার, এখন আমরা কেউ শিক্ষার্থী হতে চাই না।

ক্ষমতায় ক্ষমতায়িত হতে চাই...

লেখক : সিনিয়র লেকচারার, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

(অ/আগস্ট ১৯, ২০১৭)