আবদুল কাদের আরাফাত


‘চল, জলিলের বাড়ি ঘেরাও দিমু ।
-কি করছে জলিল?
মিনুরে এসিড মারছে ।
-আইনে আছে এসিড মারার বিচার নব্বই দিনের মধ্যে করতে হয়, ফাঁসিও হইবার পারে।’

ছোটবেলায় দেখতাম এই বিজ্ঞাপন বিটিভিতে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হতো, তখনও বুঝার বয়স হয়নি এসিড কেন মারে? এসিড মারলে কি হয়? তবে বহুল প্রচারিত এ বিজ্ঞাপন দেখে বুঝতাম এসিড মারা খুব খারাপ, এতে ফাঁসিও হতে পারে।

এ তো গেল বিজ্ঞাপনের কথা, এবার বাস্তবে ফিরে আসি । একটা সময় পত্রিকার পাতা খুললেই এসিডে ঝলসানো বর্বরতার খবর চোখে পড়তো, সে তুলনায় অনেকটাই কমেছে এই নির্মমতা। কি ভাবছেন? এই নরপশুরা আচমকা ভাল মানুষ হয়ে গেছে? আসলে তা নয়, মুল কথা হচ্ছে কার্যকর শাস্তির বিধান আর ব্যাপক প্রচারণাই এসিড সন্ত্রাসীদের লাগাম টেনে ধরেছে । তাহলে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মনে উদয় হয়- এসিড সন্ত্রাসীদের নির্মুল করার প্রত্যয়ে সফল আমরাই ধর্ষকদের রুখতে ব্যর্থ কেন? তবে কি আমরা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছি না?

তনু ধর্ষণ ও নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সর্বত্র, এর পর বেশ কয়েকটি ঘটনায় নিজকে বার বার প্রশ্ন করেছি- আমরা কি মানুষ হবো না? এসব প্রতিবাদ আর নিন্দার ঝড় কি নরপশুদের দমাতে পেরেছে? সম্প্রতি বগুড়ায় ধর্ষণের পর পুনরায় বাড়িতে তুলে নিয়ে মাথা ন্যাড়া করার দৃশ্য কি বার্তা দেয়!

আসলে কেবলমাত্র সভা সমাবেশ কিংবা বুলি আওড়িয়ে সব নরপশুর মনে কখনোই মানবিকতার জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।

ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান রেখে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের মাধ্যমে এসব নৃশংসতার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরী, পাশাপাশি মিডিয়া ব্যাপক প্রচার প্রচারণায় জানিয়ে দিবে এসব হায়েনাদের কি পরিণতি হয়। সাধারণত একটি নৃশংতার রেশ কাটতে না কাটতে আরেকটি ইস্যু পেলে আমরা পূর্বের বর্বরতা ভুলে যাই, এ থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের মিডিয়া যদি নিয়মিত ফলোআপ রিপোর্ট করে তাইলে নরপশুদের বিচারের পথ প্রশস্ত হয়, অধিকাংশ সময় প্রশাসন মিডিয়ার চাপে বাধ্য হয়ে এসব নরপশুদের দ্রুত গ্রেফতারে সচেষ্ট হয়।

ধর্ষণ নামক এই বর্বরতা থেকে মুক্তি পেতে হলে নরপশুদের উপযুক্ত শাস্তির পাশাপাশি ধর্ষক হয়ে উঠার পেছনের গল্প খুঁজে বের করতে হবে, ক্ষত চিহ্নিত না করে চিকিৎসার প্রচেষ্টা কখনোই ভাল ফল আনবে না। দানব হয়ে উঠার পথ রুদ্ধ করার প্রয়াসে ছোটবেলা থেকেই মানবিক মুল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে, এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভুমিকা পরিবারের । অভিভাবক সতর্ক দৃষ্টি রাখতে পারেন তার কোমলমতি সন্তানের সাথে অদৃশ্য কোন দানব বেড়ে উঠছে কিনা, সন্তান কোথায় যায়, কার সাথে মিশে এসব বিষয়ে খেয়াল না রাখলেই বিপত্তি। বয়স হওয়ার আগেই সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়ে নিজেই বিপদ কিনে আনছেন কিনা তা ভেবে দেখা দরকার, নিজের অজান্তেই অপরিণত বয়সে নিষিদ্ধ পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি শিশুকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে, এসব শিশু পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে কখনো কখনো হিংস্রতা নিয়ে বেড়ে উঠে, ফলশ্রুতিতে ধর্ষক হয়ে উঠার পথেও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে সম্ভাবনাময় এসব প্রাণ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে এসব নৃশংতার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্হান আশা জাগায়, তবে মাঝে মাঝে অতি আবেগ নির্যাতিতদের আরও বেশী হেয় প্রতিপন্ন করে তোলে, উদাহরণ স্বরুপ বলতে পারি- বগুড়ায় নৃশংসতার স্বীকার মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া ছবির প্রচার ওদের পুনরায় ধর্ষণের সামিল, এ বিষয়ে আমাদের আরেকটু সতর্ক হতে হবে। নির্যাতিত নয়, ধর্ষকের ছবি সর্বত্র ছড়িয়ে এদের সামাজিকভাবে বয়কট করে শাস্তির পথ প্রশস্ত করতে হবে ।

সকল বিবেকবান প্রাণের প্রয়াসই পারে মধ্যযুগীয় এই বর্বরতাকে বিদায় জানাতে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই ভুখন্ডকে নিরাপদ করে তুলতে এগিয়ে আসতে হবে এখনই, নইলে ধর্ষিতার মনে তীব্র ঘৃণা আর হাহাকারের যে স্তুপ জমছে তার নিচে চাপা পড়বো আমি কিংবা আপনি, আজ-আগামীকাল অথবা পরশু ।

লেখক : শিক্ষার্থী।