কাজী নজরুল ইসলাম, শরীয়তপুর : শরীয়তপুরের একজন সংসদ কর্তৃক বরাদ্দকৃত টি.আর-কাবিটার কোটি টাকার প্রকল্প থেকে কোন কাজ না করেই টাকা তুলে নিয়ে গেছে দলীয় বিশেষ ক্যাডার শ্রেনির আস্থাভাজনেরা। সরকারি অর্থ আত্মসাৎকারিদের টাকা ফেরতের নোটিশ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। আর, গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়ন, সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষন প্রকল্পের নামে সরকারি টাকা হরিলুটের বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে খোদ সরকার দলীয়রাই।

“এ যেন রূপকথার সেই হীরক রাজার রাজ্য শাসন। কোন কিছুই দেখার কেউ নেই। যা খুশি তাই চলছে অবলিলায়। যেমন চাইছে, তেমনই হচ্ছে সর্বত্র। দুর্নীতি আর অনিয়মের স্তুপ জমছে রাজ্যময়”। এমনিভাবেই শরীয়তপুরে সরকারি দলের এক সাংসদের স্বেচ্ছাচারিতা আর নীতিহীনতার কথা এখন সবার মুখে মুখে। তিনি আন্তঃদলীয় বিভাজন রাজনীতি করতে গিয়ে নিজের পক্ষের বিশেষ বাহিনীকে ভরণ পোষণ করছেন সরকারি বরাদ্দের টাকা দিয়ে। যা হার মানিয়েছে এ যাবৎ কালের সকল অনিয়ম আর দুর্নীতিকে।

২০১৬-১৭ অর্থ বছরে শরীয়তপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি, এম মোজাম্মেল হক তার নির্বাচনী এলাকার শরীয়তপুর সদর ও জাজিরা উপজেলায় গ্রামীন অবকাঠামো সংস্কার, রক্ষনাবেক্ষন ও উন্নয়ের জন্য টি,আর (টেষ্ট রিলিফ), ও কাবিটা (কাজের বিনিময়ে টাকা) প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ২ কোটি সোয়া ৩৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ প্রদান করেন। ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার শর্ত রেখে গত এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ থেকে ২৪ তারিখের মধ্যে তিনি এই প্রকল্পগুলো প্রেরণ করেন। এর মধ্যে ৩৮৪ টি টি.আর প্রকল্পের অনুকুলে বরাদ্দ দেন ১ কোটি ২৮ লক্ষ ৩ হাজার টাকা আর ৩৯টি কাবিটার জন্য বরাদ্দ প্রদান করেন ১ কোটি ৯ লক্ষ ১৩ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসে, বরাদ্দ দেয়া প্রকল্প গুলোর অস্তিত্ব থাকলেও এর বেশীরভাগেরই প্রয়োজনীয়তা নেই, যা শহরের পাকা সড়ক। আর গ্রামীন কাচাঁ রাস্তার নামে যে সকল প্রকল্পের খুব জরুরী প্রয়োজনীয়তা আছে সেখানেও এক পয়সার কাজ করা হয়নি। শরীয়তপুর সদর উপজেলায় বরাদ্দকৃত ৪০ হাজার ও ২৯ হাজার টাকা করে মোট ১ শত ৭৯টি টিার প্রকল্পের মধ্যে ৮০ শতাংশ প্রকল্পে কোন কাজই হয়নি। ২৪টি কাবিটা প্রকল্পে ছিটে ফোটা কাজ হয়েছে কয়েকটিতে আর বাকিগুলোতে হাতই দেয়া হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়নের পূর্বে জেলা ত্রান ও দূর্যোগ ব্যবস্থপনা কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বরাবরে চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন যে, উলেøখিত প্রকল্পের অস্তিত্ব আছে কিনা এবং বরাদ্দকৃত টাকা প্রকল্পে প্রয়োজন আছে কিনা, সে বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করতে। জানা গেছে, উপজেলা নির্বাহী প্রশাসন প্রতি প্রকল্প থেকে নির্ধারিত হারে কমিশন (ঘুষ) নিয়ে কোন তদন্ত না করেই সমুদয় টাকা পরিশোধ করেছেন কমিটিরি কাছে।

প্রকল্প বাস্তবায়নের নিয়ম হিসেবে প্রতিটি প্রকল্পের বিপরীতে ৫ সদস্যের একটি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি জমা দিতে হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে। সেখানে দেখা গেছে, টি,আর প্রকল্প বাস্তবায়নে পিতা-পূত্র, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন সহ পরিবারের সদস্য, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে এমনকি ফেইজবুক থেকে ছবি নামিয়ে ভূয়া-কাল্পনিক লোকদের নিয়ে কমিটি করে তা জমা দেয়া হয়েছে। আর এ সকল কমিটির সদস্যরা অনেকেই জানেননা কমিটিতে তাদের নাম অন্তর্ভূুক্তির বিষয়টি।

বাস্তবতা যে কখনো কখনো রূপকথাকেও হার মানায়, সে কথার প্রমান মিলে এখানেই- প্রকল্পের সভাপতি ছেলে নির্মল দাস আর সম্পাদক বাবা গীরেন দাস। বাবা জানেননা তার ছেলেকে ৪০ হাজার টাকার একটি প্রকল্প দেয়া হয়েছে, সেই প্রকল্পে তাকে করা হয়েছে কমিটির সাধারণ সম্পাদক। আর ছেলে সভাপতি হয়েও পিতাকে যে সম্পাদক করা হয়েছে সে কথাটিও তিনি নিজেই জানেননা। পিতা-পূত্র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্যামেরার সামনেই চলছিল এমন বাহাচ। মাননীয় সাংসদের দেয়া ১৩৯ টি টি.আর প্রকল্পের মধ্যে ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দের ১৩৬ নং প্রকল্প হলো সদর উপজেলার শরীয়তপুর পৌরসভার ৯ ওয়ার্ড এর নিলকান্দি বাহার আলী মসজিদ থেকে দাস বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত। এ প্রকল্পটি দেয়া হয়েছে সাংসদ মোজাম্মেল হকের বিশেষ সহচর এক আওয়ামীলীগ নেতার গাড়ি চালক নির্মল দাসকে। নির্মল দাস কোন কাজ না করেই সমুদয় টাকা তুলে নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে তাকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি কাজ করেছি কি না করেছি এটা পিআইও অফিস জানে। আমি কাজ না করলে কি আমাকে টাকা দেয়া হতো ?

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু ১৩৬ নং প্রকল্পই নয়, একই তালিকায় শরীয়তপুর পৌর এলাকার ১৩৪, ১৩৫, ১৩৭ নং প্রকল্পসহ ইউনিয়ন পর্যায়েও ৪০ হাজার টাকা করে অন্তত ১২০টি প্রকল্পের একই হাল। আর বিশেষ বরাদ্দের প্রতিটিেিত ২৯ হাজার করে দেয়া ১০০টি প্রকল্পে শরীয়তপুর সদর উপজেলার ৫০টিতেও দেখা গেছে একই চিত্র। এই বরাদ্দের অন্তত ৪০টিতে এক টাকার কাজও করা হয়নি। ২০০ মিটার এলাকার মধ্যে ৫-৭ টি প্রকল্পের নাম দিয়ে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। একই সড়কে দেয়া হয়েছে একাধিক প্রকল্প। চোখের সামনে এভাবে সরকারি টাকা লুটপাটের বিষয়টি সংশিøষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা একেবারেই নজরদারিতে নেননি, বরং সহায়তা করেছেন।

প্রকল্প এলাকার শরীয়তপুর পৌরসভা, তুলাসার, বিনোদপুর, চিকন্দিসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধি শরীয়তপুর পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্দুর রশিদ সরদার, জেলা যুবলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম লিটন শেখ, এলাকাবাসী সাহানা বেগম, রাজ্জাক খান, শাহজাহান বেপারী, নুরুল হক মাদবর জানান, আমরা জেনেছি আমাদের এলাকার রা¯Íাঘাট উন্নয়নের জন্য সরকার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু গত ৬ মাসেও এই সকল রা¯Íায় কোন কাজ হেয়ছে বলে আমরা দেখিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইউপি চেয়ারম্যান মুঠোফোনে জানান, গত ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী খোকা শিকদারকে ভোট দেয়ার বিনিময়ে ইউপি মেম্বারদের ৫০ হাজার টাকা করে দেয়ার সাংসদ মোজাম্মেল হক কর্তৃক প্রদেয় প্রতিশ্রæতি পূরণ না করায় তাদের প্রত্যেককে ৪০ হাজার টাকার একেকটি টি,আর প্রকল্প দেয়া হয়েছে। আর এতে কতটুকু কাজ হয়েছে বা না হয়েছে সে বিষয়ে তদারকি করতে তার নিজ ইউনিয়নেই তার কোন ভূমিকা নেই বলে জানালেন ওই চেয়ারম্যান।

শরীয়তপু সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জিয়াউর রহমান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কামরুন্নাহার বেগম বলেন, যে সকল প্রকল্পে কোন হয়নি সে সকল প্রকল্প কমিটির সভাপতিকে দুই দফায় চিঠি দেয়া হয়েছে টাকা ফেরৎ দেয়ার জন্য। যদি টাকা ফেরৎ না দেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক মামলা করা হবে।

শরীয়তপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা আবুল হাশেম তপাদার বলেন, আমি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য বি.এম মোজাম্মেল হক সাহেব আমার সাথে কোন সমন্বয় না করেই বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। শুনেছি এবাও তিনি টি.আর কাবিটার প্রকল্প দিয়েছেন তার বিশেষ কিছু লোকের সাথে কথা বলে। এর মধ্যে তথাকথিত এক নেতাকে একাই বিভিন্ন নামে বেনামে দিয়েছেন ৪০টি প্রকল্প।

সাংসদ বি.এম মোজাম্মেল হক এই প্রতিবেদককে মুঠো বলেন, “আমি এলাকার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প দিয়ে থাকি। এ বিষয়ে কি হয়েছে আমি ততটা জানিনা। তবে তুমি এগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি না করে পরে আমার সাথে কথা বলে নিও“।


(কেএনআই/এসপি/আগস্ট ২০, ২০১৭)