মোহাম্মদ নেয়ামত উল্লাহ, নারায়ণগঞ্জ : বিচারের প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছে রতন শিকদারের পরিবার। সরকার ও আওয়ামী লীগের কাছে এরচেয়ে বেশি কিছুই আশা করছে না ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেণেড হামলায় নিহতের এই পরিবার। ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও কান্না থামেনি এই পরিবারটির। নারায়ণগঞ্জের মাসদাইরের গাবতলীতে নিহতের এই পরিবারটি এখন আর আগের মত এ বিষয়ে কোন কথাই বলতে চায় না। তাদের মতে, এইদিনটি এলে সাংবাদিকরা এসে খোঁজ-খবর নেয়। নিউজ-টিউজ লিখে। এরপর আর কেউ মুখ ফিরেও তাকায় না।

পরিবারটির দাবি, এখন এ হামলার প্রকৃত বিচার হলেই রতনের আত্মা শান্তি পাবে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিজের প্রাণ বিপন্ন হলেও রতন শুধু জানতে চেয়েছিল-‘ আমরা নেত্রী বেচে আছে তো? দলীয় পদপদবী না থাকলেও বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রচন্ড পছন্দ ও ভালোবাসতেন রতন শিকদার। শেখ হাসিনা ভাষণ দিবেন খবরটি কানে আসলেই নাওয়া খাওয়া আর রুটি রোজগার ভুলে চলে যেতেন। ভাষণ শেষে রাতে বাড়ি ফিরে সেই গল্পও করতেন। ২০০৪ সালে সে গল্পটি আর বলা হয়নি তার।

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অন্যদের সঙ্গে মারা যান নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার গাবতলী এলাকার রতন সিকদার। ১৩ বছর আগে নৃশংস সেই ঘটনায় রতনের মৃত্যুর পর থেকেই পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। ঠিকমত তখন খোঁজ খবরও নিত না আওয়ামী লীগের লোকজন।

রতন শিকদারে ছোট ভাই কবির সিকদার টুটুল জানান, বঙ্গবন্ধু, তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের একনিষ্ট অন্ধ ভক্ত ছিলেন রতন সিকদার। ক্ষুদ্র ব্যবসার স্বল্প উপার্জনে সংসার চালানো দায় হলেও শেখ হাসিনার কোন সমাবেশ হলেই নিজের টাকা খরচ করে সেখানে ছুটে যেতেন তিনি। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট নেত্রীর টানে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছুটে গিয়েছিল রতন। বিকালে শেখ হাসিনার বক্তব্য চলাকালীন গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে নেওয়ার পথেও সঙ্গীদের কাছে বার বার জিজ্ঞেস করছিল, ‘আমার নেত্রী বেচেঁ আছে তো?’ একথা বলতে বলতে এক সময়ে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।

টুটুল আরো জানান, বাবা মৃত আব্দুল হক শিকদারও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভক্ত। রতন শিকদার ফতুল্লার বিভিন্ন টেক্সটাইল মিল হতে কাপড় কিনে দোকানে বিক্রি করতো। তিনি জানান, রতনের মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমে এক লাখ টাকা দেয়া হয়। ২০১৩ সালে রতনের দুই ছেলে মেয়েকে ২লাখ টাকা করে ফিক্সড ডিপোজিট করা হয়েছে।

রতনের স্ত্রী রোজিনা কন্যা আমেনা ও পুত্র নিয়াজুল হককে নিয়ে থাকেন মাসদাইরের গাবতলীতে।

রতন শিকদার যখন মারা যান, তখন তাঁর বড় ছেলে নিয়াজুল হকের বয়স ছিল আট। আর মেয়ে আমেনা জাহান স্বপ্নার বয়স মাত্র তিন। দই ছিল দুই ছেলেমেয়ের খুব প্রিয়। ব্যবসায়ী বাবা প্রায় দিনই ছেলেমেয়ের জন্য দই আর আইসক্রিম নিয়ে আসতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর স্বপ্না আর নিয়াজ দই-মিষ্টি আর খায় না।

রতন শিকদারের স্ত্রী রোজি বেগম বলেন, ২১ আগস্ট রাত ১১টার দিকে জানতে পারি আমার স্বামী মারা গেছে। পরদিন সকালে দুই সন্তান নিয়ে আমি স্বামীর লাশ নিতে আসি। ঘটনার পরে নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ী চলে আসেন তারা। রোজির ভাই তাদের সংসার খরচ চালান।

রতন শিকদারের মেয়ে স্বপ্না বলে, আব্বু আমার জন্য প্রায় প্রতিদিন দই নিয়ে আসতেন। আমি এখন আর দই খাই না। বাবাকে খুব মিস করি। এ শুন্যতা পূরণ হবার নয়।

রতনের স্ত্রী রোজিনার দাবি, অবিলম্বে এ হত্যাকান্ডের বিচার হোক। মরার আগে যেন বিচার দেখে যেতে পারি।

গাবতলীর বাড়িতে গিয়ে কথা হয় রতনের মা মমতাজ বেগমের সঙ্গে। ছেলের ছবিটা দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, সবার কাছে আগস্ট শোকের মাস হলেও আমার কাছে সারা বছরই শোকের মাস। প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুধু সুষ্ঠ বিচারটা চাই। বিচারটা দেখে যেতে চাই।

(এমএনইউ/এএস/আগস্ট ২০, ২০১৭)