মোহাম্মদ নেয়ামত উল্লাহ, নারায়ণগঞ্জ : ঘুরে ফিরে স্বজনদের হাতে চলে এসেছে নূর হোসেনের ‘সাম্রাজ্য’। ক্ষমতার প্রভাবে এ সাম্রাজ্যও একদিনে গড়ে উঠেনি। অপরাধ জগতের এই ‘ডন’ ক্ষমতা ও বাহুবলে দীর্ঘসময়ে গড়ে তোলেন এই ‘সাম্রাজ্য’। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার মূল পরিকল্পনাকারী ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি নূর হোসেনের উত্থান যেন সিনেমার গল্পের মতো। ট্রাকের হেলপার থেকে দুই দশকে তিনি বনে যান কোটিপতি ও বিশাল অপরাধী চক্রের নিয়ন্ত্রক। তার চলাফেরাও ছিল ফিল্মি কায়দার। 

কোথাও যাওয়া-আসার সময় সামনে পেছনে থাকতো গাড়িবহর। দেহরক্ষীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র সজ্জিত হয়ে চারদিক থেকে ঘিরে রাখতো নূর হোসেনকে। অবৈধ টাকা, দাপুটে ক্ষমতা ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে নির্বাচিত হয়েছিলেন সিটি কর্পোরেশনের ৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে। তবে কাউন্সিলর হলেও সর্বত্র তাকে হোসেন চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যান নামেই চিনতো সবাই। মূলত কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আর্বিভূত হন স্বরূপে। অপরাধ জগতের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তার পদচারণা ছিল না। অপরাধের এসব শাখা নিয়ন্ত্রণের জন্য গড়ে তোলেন নিজস্ব বাহিনীও।

সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকা থেকে কাঁচপুর সেতুর নিচে শীতলক্ষ্যা নদী পর্যন্ত ফুটপাত, বালুর ঘাট, ট্রাকস্ট্যান্ড, মাছের বাজার, আন্তঃজেলা ট্রাক ইউনিয়ন, পরিবহনে চাদাঁবাজি করতো নূর হোসেন। এছাড়া ট্রাকস্ট্যান্ডের মাঠে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর যাত্রার নামে জুয়ার আসর, মাদক ব্যবসাসহ সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ তার হাতে ছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। এখন নূর হোসেনের হয়ে তার ভাই, ভাতিজা ও সাবেক সহযোগীরা এসব দেখভাল ও ভোগ করছেন বলে জানা গেছে।

২০১৪ সালে সাত খুনের পর নূর হোসেন, তার ভাই নূর সালাম, নূরুদ্দিন, নূরুজ্জামান জজ, ভাতিজা কাউন্সিলর শাহজালাল বাদলসহ পরিবারের নারী-পুরুষ প্রায় সব সদস্য পলাতক ছিলেন। ঘটনার প্রায় এক বছর পর একে একে এলাকায় ফিরতে শুরু করেন নূর হোসেনের ভাই ভাতিজা ও সহযোগীরা। অভিযোগ ওঠে, তারা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ফের দখল নিতে শুরু করেন নূর হোসেনের ফেলে যাওয়া সাম্রাজ্য। এরই মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদল দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিতও হন।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে নূর হোসেনের পরিবহণ সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করছেন তার ছোট ভাই নূরুদ্দিন। শিমরাইল ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোড় থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তার পাশের ফুটপাত, দোকানপাট থেকে চাদাঁবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন নূর হোসেনের ভাতিজা শাহ জালাল বাদল। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের পাথর ঘাটের নিয়ন্ত্রণ করছেন নূর হোসেনের ছোট ভাই নুরুজ্জামান জজ। এছাড়া ভেজাল জায়গা জমি কেনাবেচার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন নূর হোসেনের বড় ভাই নূর সালাম। যাকে এলাকার লোকজন ‘বোবা-ডাকাত’ উপাধিও দিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ড পর্যন্ত ফুটপাতের চাঁদা আদায় করেন নূর হোসেনের ভাতিজা কাউন্সিলর শাহজালাল বাদল। সড়ক ও জনপথ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিশাল জায়গা ও খাল দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল টিনশেড মার্কেট। সম্প্রতি শিমরাইল মসজিদের পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল করে প্রায় শতাধিক টিনশেড ঘর নির্মাণ করে প্রতিটি ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এসব ঘর থেকে অগ্রিম নেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া ফুটপাত, ভাসমান রেস্তোরাঁ, বাস কাউন্টার, মুচির দোকান, মোবাইল পণ্যের দোকান, ফলের দোকান, ফ্লেক্সিলোডসহ প্রায় ৫শ’ দোকান থেকে প্রতিদিন ১৫০ টাকা থেকে ৪শ’ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।

এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে কাউন্সিলর নূর হোসেনের ভাতিজা শাহজালাল বাদলের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি না হয়ে তড়িঘড়ি করে ফোন কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।

স্থানীয়রা জানান, সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ করেন নূর হোসেনের এক সময়ের ঘনিষ্ট সহযোগী সিটি কর্পোরেশনের ৪নং কাউন্সিলর আরিফুল হক হাসান। তাকে সহায়তা করেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। ট্রাকস্ট্যান্ডের প্রতিটি ট্রাক থেকে দিনে ৩শ’ টাকা থেকে ৪শ’ টাকা করে আদায় করা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে বুধবার দুপুরে কাউন্সিলর আরিফুল হক হাসানের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

ঢাকা দাউদকান্দি রোডে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বাসের হেলপার জানান, আন্তঃজেলা পরিবহন সমিতির নামে বাইরে প্রতিদিন ঢাকা-চট্রগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-দাউদকান্দি, নরসিংদী, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন দূরপাল্লা ও স্বল্পদূরপাল্লার পরিবহন থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন নূর হোসেনের ভাই নূরুদ্দিনের লোকজন। কোনও বাসের কন্ডাক্টর, হেলপার বা ড্রাইভার টাকা দিতে না চাইলে মারধর করা হয়। প্রতিটি বাস থেকে একশ থেকে ১৫০ টাকা এবং লেগুনা টেম্পু থেকে আদায় করা হয় ৫০ টাকা থেকে একশ টাকা করে।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, নূর হোসেনের ভাই নূরুজ্জামান জজ নিয়ন্ত্রণ করেন শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের পথরের ব্যবসা। প্রতি ট্রাক লোড হলেই নূরুজ্জামান জজকে দিতে হয় ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। এছাড়া নদীর ঘাটের ব্যবসায়ীদের মাসিক একটা চাঁদা দিয়ে তাদের ব্যবসা করতে হয় বলে একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান।

শিমরাইল রেন্ট-এ কার স্ট্যান্ড ও টেম্পো স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন সাত খুন মামলার চার্জশিট থেকে বাদ পড়া সেচ্ছাসেবকলীগ নেতা আমিনুল হক রাজু। এছাড়া শ্রমিক লীগ নেতা সামাদ বেপারীসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা আন্তঃজেলা পরিবহন সমিতির নামে চাঁদা আদায় করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ ব্যাপারে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনজার্চ ওসি আব্দুস সাত্তার বাংলা বলেন, এই থানায় আমি যোগদান করেছি প্রায় এক মাস হলো। নূর হোসেনের ভাই-ভাতিজাদের নাম এখনও ঠিকমতো জানি না, তাদের চিনিও না। ফুটপাত, পরিবহন সেক্টরের চাঁদাবাজি বিষয়ে ওসি বলেন, এসব বিষয়ে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নূর হোসেনের যত সম্পত্তি
সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে নূর হোসেনের নামে রয়েছে বেশ কয়েকটি বাড়ি, মাছের খামার ও পরিবহন ব্যবসা। শিমরাইল মৌজায় ৩৭৩ নম্বর দাগে প্রায় ১১ শতাংশ জমির ওপর ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ তলা বাড়ি নির্মাণ করেন নূর হোসেন। শিমরাইল মৌজার ৭২ ও ৭৩ নম্বর দাগে ১০ শতাংশ জমির ওপর ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬ তলা বাড়ি নির্মাণ করেন তিনি। শিমরাইল মৌজায় ৩১২ নম্বর দাগে ১০তলা ফাউন্ডেশনের ওপর ৬ তলা বাড়ি আছে। রসুলবাগে সাড়ে ৮ কাঠা জমির ওপর ৭ তলা বিলাসবহুল ভবন। এ জমির অর্ধৈক সরকারের। এ ছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জ মৌজায় ১০ শতাংশ জমির ওপর ৭ তলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।

সূত্র জানায়, রাজধানীর গুলশান-২-এ দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে নূর হোসেনের। গুলশান লেকের বিপরীতে ৩ হাজার ৬শ’ স্কয়ার ফুটের ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে তার। এ ছাড়া বনানী ও ধানমন্ডিতে আরও ২টি ফ্ল্যাট রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী নূর হোসেনের মালিকানাধীন এবিএস পরিবহনের ৩২টি বিলাশবহুল বাস রয়েছে। ব্যক্তিগত চলাফেরার জন্য নূর হোসেনের ৪টি গাড়ি ছিল।

জানা যায়, নূর হোসেন কমপক্ষে ৫০ বিঘা জমির মালিক। এর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ আঁটি মৌজায় ২ বিঘা জমি রয়েছে। ওই মৌজায় ৪২৮ দাগে প্রায় ৩০ শতাংশ জমি রয়েছে তার। যার বর্তমান মূল্য আড়াই কোটি টাকা। সানারপাড় এলাকায় প্রায় তিন বছর আগে কিনেছিলেন ৪ বিঘা জমি। নিমাইকাশারী এলাকায় শিক্ষক মর্তুজা আলীর স্ত্রী জাহানারার কাছ থেকে একশ কোটি টাকায় এ জমি কিনেছিলেন তিনি। এর মধ্যে ২০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এখনও ৮০ কোটি টাকা পাওনা আছে জাহানারার। মুক্তিনগরে তার রয়েছে ১৫ কাঠা জমি। নূর হোসেনের শিমরাইলের বাড়ির পেছনে রয়েছে ৪০ বিঘার মৎস্য খামার। সাত খুনের আসামি হওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি দল নূর হোসেনের সম্পদের খোঁজ শুরু করে। পরে নূর হোসেন ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে।

ট্রাক হেলপার থেকে যেভাবে অপরাধ জগতের ডন
১৯৮৫ সালে সিদ্ধিরগঞ্জের ইকবাল গ্রুপের মালিকের ট্রাকের হেলপার ছিলেন নূর হোসেন। বছর খানেক পর ট্রাক ড্রাইভার বনে যান তিনি। ১৯৮৭ সালে তার বাবা বদরুদ্দিন একটি পুরনো ট্রাক কিনলে নূর হোসেন ওই ট্রাক চালাতে শুরু করেন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১৯৯২ সালে বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিনের আশীর্বাদে সিদ্ধিরগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিন বছর পর ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে আদমজীতে খালেদা জিয়ার জনসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। শুরু করেন প্রকাশ্যে রাজনীতি। এর আগে তৎকালীন বিএনপি নেতা বর্তমানে এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের গাড়িতে বোমা হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এভাবেই আলোচনায় আসেন নূর হোসেন। একসময় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও নূর হোসেনকে একনামেই চিনতো। এলাকায় প্রচার রয়েছে, নূর হোসেন খালেদা জিয়াকে মামী বলে ডাকত।

স্থানীয়দের দাবি, নূর হোসেনের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল কাঁচপুরে। ১৯৯৮ সালে অনেকটা চাপের মুখে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। পরে খালেদা জিয়ার লং মার্চ ঠেকানোরও অভিযোগও উঠে তাঁর বিরুদ্ধে।

২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে দেশে ছেড়ে ভারতে চলে যান নূর হোসেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশে ফিরে এসে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চাদাঁবাজি, মাদক ব্যবসা, পরিবহনে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।

(এমএনইউ/এএস/আগস্ট ২৩, ২০১৭)