রাজন্য রুহানি, জামালপুর : দেশের সর্ববৃহৎ ইউরিয়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা সার কারখানা থেকে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকার তরল এমোনিয়া গ্যাস, মূল্যবান যন্ত্রাংশ ও ট্রাক বোঝাই সার। এই পাচারচক্রের নেপথ্যে কাজ করছে দুটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। প্রকাশ্যেই চলছে পরিবহণ চাঁদাবাজি। কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণেই চলছে বিভিন্ন বন্টন ব্যবস্থা। একাধিকবার গ্যাস, সার ও যন্ত্রাংশ পাচার ধরা পড়লেও এমন ঘটনা থেকে অপরাধী ও অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের ইশারাতেই। গত আগস্ট যমুনার ১নং জেটিঘাটে সার পাচারকালে ট্রাক ভর্তি ১০ মেট্রিকটন সার আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে স্থানীয় লোকজন। প্রভাবশালীর চাপে আটকের ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও মামলা নিতে পারে নি সরিষাবাড়ি থানার পুলিশ।

১৯৯১ সালে যমুনা সারকারখানাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের সর্ববৃহৎ এই ইউরিয়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পর থেকে কোটি কোটি টাকা মুল্যের তরল এমোনিয়া গ্যাস বাজারে ছেড়ে দেয়া হতো। এমোনিয়া গ্যাসের তেজস্ক্রিয়তার কারণে কারখানার আশপাশ এলাকার গাছপালা ও ফসলে ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশও মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়ে যা মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এমোনিয়ার তেজস্ক্রিয়া থেকে কারখানা এলাকার মানুষজন নিজেদের এবং পরিবেশ রক্ষার্থে মানববন্ধন কর্মসূচিসহ একাধিকবার আন্দোলন করেছে। এলাকাবাসীর আন্দোলনের মুখে ২০১৪ সাল থেকে কারখানার উৎপাদিত তরল এমোনিয়া গ্যাস সিলিন্ডারে ভরে ডিলারদের মাধ্যমে বাজারজাত শুরু করে বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ। প্রথম বছর এ ব্যবসার পরিধি কিছুটা কম থাকলেও বর্তমানে ডিলারের সংখ্যা ১শ ৫৪ জন। কারখানার তালিকাভুক্ত ডিলাদের মধ্যে ৩৫ জন জেলার বাইরে, কিছু জামালপুর ও সরিষাবাড়ির। অবশিষ্ট ডিলাররা মিলগেট, ঢুরিয়াভিটা, তারাকান্দি, কান্দারপাড়া, পাখিমারা, জেটিঘাট ও বয়ড়াসহ আশপাশের এলাকার।

কারখানার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যমুনা সার কারখানা থেকে ১ হাজার ৩১১.৬৫ মেট্রিকটন তরল এমোনিয়া গ্যাস যা ২৬ হাজার ২৩৩টি সিলিন্ডার ডিলারদের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়েছে।

যমুনা সার কারখানার তরল এমোনিয়া গ্যাস আলুর কোল্ডস্টোরেজ, মাছের হিমাগার, অন্যান্য কোল্ডস্টোরেজ, গ্লাস ফ্যাক্টরি, ব্লেড ফ্রাক্টরি, এসির কম্প্রেসার, গার্মেন্স ফ্যাক্টরির নাইকার তৈরির কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। তরল এই এমোনিয়া গ্যাসের ব্যাপক চাহিদা থাকায় নিজেদের নাম ছাড়াও ভাই-ভাতিজা, বোনজামাই, নিকটাত্মীয়দের নামে একাধিক লাইসেন্স নিয়েছে সারকারখানা এলাকার প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সদস্যরা। গ্যাসের গোটা ব্যবসাকে নিজেদের কুক্ষিগত করার জন্য ‘তরল এমোনিয়া গ্যাস সমবায় সমিতি’ নামে একটি সমিতি গঠন করে তারা। কারখানার কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে সিন্ডিকেটের নেতারা তাদের ইচ্ছামতো সমিতির মাধ্যমে নিজেরা ও নিজেদের লোকদের লাইসেন্সের নামে প্রতিমাসে একাধিকবার বরাদ্দ নেয়। বাদ পড়ে অন্য ডিলাররা। যারা ম্যানেজ করতে পারে তারাও সিলিন্ডার প্রতি ২ হাজার টাকা জমা দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

তরল এমোনিয়া গ্যাস সিলিন্ডার ভুয়া চালানের মাধ্যমে সিন্ডিকেটের সদস্যরা উত্তোলন ও বাজারজাত করে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। ডিলারদের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২১ আগস্ট দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) টাঙ্গাইল সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আমির হোসেনের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি তদন্ত টিম কারখানায় তদন্ত কার্যক্রম চালায়। দুপুর ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তদন্ত করে ১১৩ টি এমোনিয়া গ্যাস সিলিন্ডারের মধ্যে ৯৯টি ভুয়া চালানে সরবরাহের প্রমাণ পান তাঁরা। সেগুলো জব্দ করে কারখানা কর্তৃপক্ষের জিম্মায় রাখা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, ভুয়া চালানে তরল এমোনিয়া গ্যাস পাচারের ঘটনায় তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। তদন্ত শেষে মামলা দায়ের করা হবে।

জব্দকৃত গ্যাস সিলিন্ডাররাগুলো তারাকান্দি ট্রাক ট্যাঙ্কলড়ি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামের বুশরা বাণিজ্যিক সংস্থা, তার ভাই শফিকুল ইসলামের রিক্তা এন্টাপ্রাইজ, তার বোনজামাই ফরহাদ আলীর জাহাঙ্গীর এন্টারপ্রাইজ, ঢাকার আহম্মেদ নগরের সিয়াম এন্টারপ্রাইজ, মোস্তাক আহম্মেদ তালুকদারের সরিষাবাড়ি ট্রেডার্স, আরামনগর বড় বাজারের মাসুদুর রহমানের নিহা এন্টারপ্রাইজ, তারাকান্দি ট্রাক ট্যাঙ্কলড়ি মালিক সমিতির সভাপতি ও আওনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. বেলাল হোসেনের বি হোসেন ও পিংনা ইউপি চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেনের আলমাস এন্টাপ্রাইজের বলে জানিয়েছে কারখানার একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র।

ডিলাররা বলেন, শতকরা ১৫ ভাগ ভ্যাট ও সিলিন্ডার প্রক্রিয়াজাত খরচসহ ১ হাজার ৯শ ৮০ টাকা মূল্যের গ্যাসসিলিন্ডার ৭ থেকে ১৩ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এভাবেই তরল এমোনিয়া গ্যাসের ব্যবসা নিজেদের কব্জায় নিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে এই সিন্ডিকেটটি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিলাররা জানান, সিন্ডিকেটের কব্জায় নিয়ে ২ হাজার টাকার সিলিন্ডার ৪ থেকে ৬ গুণ বেশি মূল্যে গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছে তরল এমোনিয়া গ্যাস। ডিলাদের কাছে থেকে সমিতির নামে ২ হাজার টাকায় প্রতিটি সিলিন্ডার জমা নিয়ে যৎসামান্য লভ্যাংশ হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে প্রভাব ও ক্ষমতার জোরেই। এতে ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে সাধারণ ডিলাররা। পাশাপাশি উচ্চমূল্যে গ্যাস কিনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিভিন্ন ইন্ডাষ্ট্রিজ মালিকেরা। ডিলাররা এই অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে উল্টো লভ্যাংশ না দিয়ে কারখানার আশেপাশে ঢুকতে দেওয়া হয় না বলেও ডিলাররা অভিযোগ করেছেন।

সমিতির নামে সিলিন্ডার প্রতি ২ হাজার টাকা জমা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তারাকান্দি তরল এমোনিয়া গ্যাস সমবায় সমিতির সভাপতি মো. জুলফিকার আলী তালুকদার শওকত বলেন, কিছু ডিলার তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছে।

(আরআর/এএস/আগস্ট ২৮, ২০১৭)