রাজন্য রুহানি, জামালপুর : সর্বগ্রাসী যমুনা সবকিছু কেড়ে নিয়েছে মানুষের। দু দফা বন্যায় জামালপুরের যমুনাপাড়ের মানুষজন একদিকে যেমন সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে আসন্ন ঈদে সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে ব্যর্থ হয়ে নিরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলছে অসহায় মা-বাবারা। হাতে টাকা নেই। ঘরে খাবার নেই। এরই মধ্যে ঈদে অবুঝ সন্তানদের নতুন কাপড়ের বায়না। সন্তানদের বায়না মেটাতে কোনো উপায় নেই বন্যা কবলিত এলাকার অসহায় মা-বাবাদের। বন্যায় নিঃস্ব হয়ে পড়া মা-বাবারা ঈদে সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে নতুন জামা কাপড় পাওয়ার আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ধনবানদের বাড়ি বাড়ি। এমনই চিত্র এখন যমুনাপাড়ের দুর্গত এলাকাগুলোর।

দুর্গত এলাকাগুলো ঘুরে দেখা হয় বন্যা কবলিত জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার মদনের চর গ্রামের করিমন বেগমের সাথে। দু সন্তান নিয়ে তিনি বাঁধের উপর ঝুপড়িঘরের সামনে গৃহস্থালির কাজ করছেন। বাঁধের কাছেই তাঁর স্বামী গোলাম রব্বানী বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরটি মেরামতে ব্যস্ত। মেরামতের প্রয়োনীয় টাকাও তাদের হাতে নেই। তিন দিন পরেই ঈদ। ঘরটি মেরামতে সময় লাগবে আরো কয়েকদিন। অবস্থাদৃষ্টে বুঝা গেল ঝুপড়িঘরেই তাদের কাটাতে হবে এবারের ঈদ। কিন্তু সন্তানেরা ধরেছে নতুন কাপড়ের বায়না। ঘর মেরামতের টাকাই নেই, নতুন কাপড়-চোপড় কেনার বায়নাতে বাবা-মা’র মাথায় এখন বাজ পড়ার মতন অবস্থা। তাদের চোখেমুখে এখন ঘোর অন্ধকার।

ইসলামপুর উপজেলার চিনাডুলি ইউনিয়নের বামনা গ্রামে গিয়ে দেখা যায় করুণ চিত্র। যমুনার পাড়ঘেঁষা এই গ্রামটিতে দু দফা বন্যায় কেড়ে নিয়েছে মানুষের সকল সুখ। বিধ্বস্ত ব্রিজ-কালভার্ট, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ও লন্ডভন্ড রাস্তাঘাট সব মিলিয়ে এই গ্রামটিকে এখন চেনাই যায় না। পানির প্রবল তোড়ে এই গ্রামের বাড়িঘরগুলো নুইয়ে পড়েছে। যারা বাড়ি ফিরে গেছে তাদের হাতে টাকা না থাকায় মেরামতও করতে পারছে না। পানি নেমে গেলেও অনেক স্থান এখনো বসবাসের অনুপযোগী হওয়ায় অনেকেই বাড়ি ফিরতে পারেন নি। বাঁধ ও উঁচুস্থানে আশ্রয় নেওয়া এই গ্রামের দুর্গতদের বাঁধেই কাটবে তাদের এবারের ঈদ। সেখানেই দেখা হয় আসমা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, ঘরবাড়িত ফিরবার পাইতেছি না। বন্যায় ভাইঙ্গে পড়া ঘর ঠিক করমু হেই ট্যাহাও নাই। পেঠে ভাত দিবারই পাইতাছি না, আমগো আবার ঈদ কিয়ের? পোলাপান নয়া কাফড়ের বায়না ধরছে, দিমু কুঠায় তনে? ঈদের দিন পোলাপানের মুহে এক চামুচ সামাই তুইলে দেওনের অবস্থাও আমগো নাই। একই ইউনিয়নের বলিয়াদহ গ্রামের ষাটোর্ধ নুরজাহান বেওয়ার কেউ নেই। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে তাদের বউ-পরিবার নিয়ে চলে গেছে অন্যত্র। অসুস্থ শরীরে বৃদ্ধা নুরজাহান নিজেই ঘর গোছাতে বেড়া নিয়ে টানাটানি করছেন। চাল ছাড়া ওই ক্ষতিগ্রস্থ ঘরটিতেই কাটবে তাঁর ঈদ। তাঁর গায়ে নতুন কাপড় উঠবে কিনা, জুটবে কিনা ঈদখাবার, জানেনা এই বৃদ্ধা। চোখের পানি মুছতে মুছতেই তিনি বললেন, আমগো মতো বানভাসীদের আবার ঈদ! এই বলে গভীর দীর্ঘশ^াস ছাড়লেন তিনি।

এবারের ঈদুল-আযহা জামালপুরের ৭ উপজেলার বন্যাদুর্গতদের মধ্যে কোনো বিশেষ বার্তা বা আনন্দ বয়ে নিয়ে আসবে না। বন্যার ক্ষয়ক্ষতিতে দিশেহারা যমুনাপাড়ের মানুষজনদের মধ্যে এবারের ঈদ যেন মরার উপর খাড়ার ঘাঁ’র মতো, করুণ ও নিরানন্দের। বন্যাদুর্গত এলাকার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ি ও বকশিগঞ্জের সিংহভাগ গ্রামেই দেখা গেছে এমন চিত্র।

(আরআর/এএস/আগস্ট ২৯, ২০১৭)