পিরোজপুর প্রতিনিধি : নৌকা চালিয়ে স্কুলে যাচ্ছে শিশুরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিনই নিজেরাই খালে রাখা ছোট ছোট নৌকায় উঠছে। এরপর নৌকায় চড়ে নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জোয়ার-ভাটার তীব্র সোত ও সামান্য ঢেউয়ে কিংবা অসাবধানতার কারণে নৌকা উল্টে দুর্ঘটনার আশঙ্কা উপেক্ষা করে স্কুলে ছোটে এসব শিশু। স্কুলের আশপাশে খাবারের দোকান নেই। ক্ষুধা লাগলে পানি খেয়েই ক্ষুধা নিবারণ করে। যুগযুগ ধরে এভাবেই শিক্ষা গ্রহণ করে আসছে নাজিরপুর বিলাঞ্চলের মনোহরপুর এলাকার জনগণ। কিন্তু মাত্র ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলেই পাল্টে যাবে স্কুলের পরিবেশ।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা থেকে উত্তর পূর্বকোনে এবং গাওখালী বাজার থেকে উত্তর দিকে ৫ কিলোমিটার দূরে মনোহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটি পিরোজপুর ভৌগোলিক সীমারেখার শেষ প্রান্তে। এর আশপাশে আরো ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও নাজুক। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের অনেকটা উন্নতি হয়েছে। অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে বিল ডুমরিয়া, বাঁশপাড়া মনোহরপুর, সোনাপুর ও ত্রিগ্রাম প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জানান, ছোট-ছোট নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুগের পর যুগ স্কুলে আসা-যাওয়া করে তারা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারের উচ্চপদে চাকরি করছেন এখন অনেকেই।

১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠিত মনোহরপুর প্রাথমিক স্কুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারি চাকরি করে অনেকে অবসর নিয়েছেন। অনেকে মারা গেছেন। এখনও অনেকে কর্মরত রয়েছেন উচ্চপদে। কিন্তু পরির্বতন হয়নি মনোহরপুর স্কুলসহ বিলাঞ্চলের অন্যান্য স্কুলের। মাত্র ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলেই পাল্টে যাবে স্কুলের পরিবেশ।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনোহরপুর প্রাথমিক স্কুলটি সরকারি করেন। এরপর থেকে সরকার আসে সরকার যায় স্কুলগুলোতে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমে না। স্কুলগুলোর কর্তৃপক্ষ সরকারের নীতি নির্ধারকসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে শুধু এসব কাজের আশ্বাস পেয়ে আসছেন।

মনোহরপুর স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষার্থীদের দাবি নিরাপদে স্কুলে আসা যাওয়ার জন্য ৬ কিলোমিটার সড়ক ও স্কুল চত্বরে একটি সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণ করে দেয়ার।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার বর্ষা মৌসুমেই শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে থাকে। আর শীতকালে তাদের কষ্ট হয় বেশি কারণ ওই সময় বিলে ও খালে পানি থাকে না। খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। কোনো বাহনই চলে না তখন। তখন জোয়ার-ভাটায় নির্ণয় করে ক্লাস নেয়া হয়। তারপরও স্কুলে যেতে তাদের কাদা পেরিয়ে যেতে হয়। শিক্ষার্থীরাসহ শিক্ষকদের এক সেট জামা কাপড় স্কুলেই রেখে দিতে হয়।

সরেজমিনে মনোহরপুর স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা ছোটাছুটি করে বিদ্যালয়ের সামনের খালে রাখা ছোট ছোট নৌকায় উঠছে। এরপরই তারা নৌকায় চড়ে নিজ নিজ বাড়ীর উদ্দেশে রওনা হয়।

মনোহরপুর প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক সমীরণ রায় জানান, বছরের ১২ মাসই শিক্ষকসহ শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ৬ কিলোমিটার রাস্তা হলে এই দুর্ভোগ আর থাকে না। মনোহরপুর প্রাথমিক স্কুলে ৪ জন শিক্ষক রয়েছেন। আরো দুইজন শিক্ষকের পদ শূন্য। নিয়োগ হচ্ছে না। এছাড়া দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ আছে। কেবল এই স্কুলে বিদ্যুৎ নেই।

মনোহরপুর মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনিল বরাল জানান, স্কুলটি থেকে প্রতিবছরই শতভাগ শিক্ষার্থী এএসসি পরিক্ষায় পাস করে থাকে। শিক্ষক মাত্র ১২ জন। টিনসেট স্কুলে ঝুঁকি নিয়ে ক্লাস করাতে হচ্ছে। গত বছর ৩৫ জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরিক্ষা দেয় ৩৫ জনই পাস করেছে।

স্কুলের সাবেক ম্যনেজিং কমিটির সভাপতি বাবুল আকন জানান, জানপ্রতিনিধিরা আশ্বাস দিয়েছেন স্কুলে যাতায়াতের জন্য সড়ক নির্মাণ করে দেয়াসহ ভবন নির্মাণের। কিন্তু তাদের আশ্বাস বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মনোহরপুর থেকে পদ্মাডুবি পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ হলেই শিক্ষার্থীদের আর ঝুঁকি থাকে না।

এসব বিষয় নিয়ে পিরোজপুর-১ আসনের এমপি একেএমএ আউয়াল বলেন, বিলাঞ্চলের স্কুলের সমস্যা নিয়ে শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশেষ বরাদ্দ চাওয়া হবে। আশা করি অচিরেই বিলাঞ্চলের স্কুলগুলোর বিরাজমান সমস্যা সমাধান হবে।

পিরোজপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. খায়রুল আলম শেখ বলেন, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নৌকা চালিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করে শুনে আমি সরেজমিনে দেখতে গিয়েছি। স্কুলগুলোর সমস্যা সমাধান করার জন্য উদ্যোগ নেব। শিগগিরই বিরাজমান সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগের কাছে চিঠি পাঠানো হবে।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৭)