পীরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি : পীরগঞ্জে একটি মামলায় ৫ পরিবারের ৪ জন আসামী জামিনে থাকলেও পরিবারগুলোর ২০ জন সদস্য প্রায় ৩ মাস ধরে বাড়ীঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

পীরগঞ্জ থানার ৩ দারোগা তাদেরকে অন্য মামলায় ফাঁসানোর হুমকি এবং মানসিক নির্যাতন করায় নারী-শিশু, পুরুষরা বাড়ী ছাড়া হয়ে আছে বলে জানা গেছে। এমনকি পরিবারগুলোর শিক্ষার্থীরাও স্কুল কলেজে যেতে পারছে না। উপজেলার মাগুড়া গ্রামে ওই ঘটনায় গ্রামবাসীও হতবাক হয়েছে।

মামলা ও এলাকাবাসীর সুত্রে জানা গেছে, গত ১৮ জুন দুপুরে সুদের টাকা পাওয়াকে কেন্দ্র করে উপজেলার মিঠিপুর ইউনিয়নের হাসানপুর গ্রামের মোস্তা মিয়া (৫০) কে মদনখালী ইউনিয়নের জাফরপাড়া বাজারে গাছে বেঁধে জাফরপাড়ার (পন্ডিতপাড়া) সাইফুল ইসলাম মারধর করে। পরে তাকে আহত অবস্থায় সাইফুলের বাড়ীতে এবং পরে স্থানীয় মহিলা ইউপি সদস্য মোর্শেদা বেগমের মাগুড়া গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়।

ওইদিনই বিকেলে থানার দারোগা মোসলেম উদ্দিন, দারোগা প্রলয়সহ কনষ্টেবলরা ওই মহিলা ইউপি সদস্যের বাড়ী থেকে মোস্তাকে উদ্ধার এবং মহিলা ইউপি সদস্যের স্বামী আশরাফুল ইসলাম ওরফে ফুলকে আটক করে মামলা করে। মামলায় ফুল কে প্রধান আসামী এবং মহিলা ইউপি সদস্য মোর্শেদা বেগম, তার দেবর খাজা মিয়া, ছোট জা খাজিদা বেগমকেও আসামী করা হয়েছে। মামলা নং- ২৬, তাং ১৮/৬/১৭। অথচ মোস্তাকে মারপিটকারী সাইফুল ইসলামকে ২ নং সহ ১২ জনকে আসামী করা হয়। আসামীরা ২০ জুন জামিনে আসে। কিন্তু ৩ দারোগা ওই মহিলা ইউপি সদস্যের ৫ পরিবারের সদস্যদেরকে অন্য মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়ায় ২০ সদস্য বাড়ীতে ফিরতে পারছে না। এ ভাবেই ৩ মাস ধরে তারা তাদের দুরদুরান্তের আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে ভয় আর আতংক নিয়ে রাত যাপন করছে।

গত মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মদনখালী ইউনিয়নের মাগুড়া গ্রামে মহিলা ইউপি সদস্যের ৫ পরিবারের প্রতিটি বাড়ীর আঙ্গিনায় কেঁচোর পায়খানায় ভর্তি। শ্যাওলাও জমেছে। বৃষ্টিতে চুলোগুলোও ক্ষয়ে গেছে, ঘাসও জন্মেছে। রান্না করার খড়ির গোলায় উই পোকা ধরে পচন ধরেছে। অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন বাড়ী ঘরে গবাদিপশু, হাঁস, মুরগীর বালাই নেই। শুনশান নিরবতা। যেন ভুতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছে। এ ভাবেই ৩ মাস ধরে ওই ঘরবাড়ীগুলো মানুষশুন্য অবস্থায় পড়ে আছে। কিন্তু তাদেরকে এ সময়ে পল্লী বিদ্যুতের মিনিমাম (সর্বনিম্ন) বিল পরিশোধ করতে হয়েছে।

পলাতক মহিলা ইউপি সদস্য মোর্শেদা বেগম বলেন, আমি মোসলেম দারোগার ভয়ে ইউপি কার্যালয়েও যেতে পারছি না। তিনি আমার কাছে ২ লাখ টাকা চাইলে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। পাশাপাশি আমার কলেজ পড়–য়া মেয়ে এবং মাদরাসা পড়–য়া ছেলেকে দারোগা আব্দুল মতিন ও মোসলেম উদ্দিন অন্য মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে। আমরা যদি বাড়ীতে আসি সে খবর দেয়ার জন্য গ্রামের কয়েকজনকে দারোগারা তাদের মোবাইল নম্বর দিয়ে গেছে।

কলেজ পড়ুয়া শামীমা খাতুন জানায়, আমি খালাশপীর বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেনীতে পড়ি। কলেজে গেলে দারোগারা আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়ায় কলেজে যাচ্ছি না। সেইসাথে আমার ভাই সোহান জাফরপাড়া দারুল উলুম কামিল মাদরাসার ৭ম শ্রেনীর ছাত্র। তাকেও আসামী করার হুমকি দেয়ায় সেও ৩ মাস ধরে মাদরাসায় যায়নি। আমরা এভাবে আর কতদিন পালিয়ে বেড়াবো?

মামলার প্রধান আসামী কাঠ ব্যবসায়ী ফুল মিয়া বলেন, আমরা সবাই ৩ মাস ধরে পুলিশের ৩ দারোগার ভয়ে বাড়ীছাড়া। ছেলেমেয়েদেরকেও আসামী করার হুমকি দিচ্ছে। রোজগার করতে না পারায় খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছি।

গ্রামবাসী পারুল বেগম জানায়, ফুল মিয়াকে টেনেহিচড়ে পুলিশ গাড়ী তুলে নেয়। এ সময় আমরা দেখতে গেলে পুলিশ আমাদেরকে তাড়িয়ে দেয়। আবার তার ছেলেমেয়েকেও ধরবে বলে জানিয়েছে।

মামুন মিয়া জানায়, পুলিশ মনগড়াভাবে নিরপরাধ ব্যক্তিদেরকে আসামী করেছে। বাড়ী ছাড়া পালিয়ে থাকা সদস্যরা হলো, আশরাফুল ইসলাম ফুল মিয়া (৫০), মহিলা ইউপি সদস্য মোর্শেদা (৪০), মেয়ে শামীমা (১৭), সোহান (১৩) ও হাওয়া বিবি (১১), লাল মিয়া (৩০), তার স্ত্রী খাদিজা (২৫), তাদের জমজ ছেলে হোসাইন (১২)ও হাসাইন (১২), হারুন (২৮), তার স্ত্রী রাশেদা (২৫), ছেলে হাবিব (৮), মেয়ে হাবিবা (১), খাজা মিয়া (২৬), তার স্ত্রী নুরজাহান (২৪), ৭ মাসের ছেলে জুন্নরাইন, মশিউর (২৩), তার স্ত্রী মিতু (২০), ছেলে নুর মোহাম্মদ (২), শাশুড়ী আমেন (৬০)।

এ ব্যাপারে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিন বলেন, আসামীরা পলাতক থাকায় তাদের সাথে কোন যোগাযোগ হয়নি, টাকাও চাইনি। ওই মামলায় চার্জশীট দিয়েছি।

মামলার বাদী মোস্তা মিয়া জানায়, আমি মামলায় কোন আসামী করিনি। পুলিশই সব করেছে। আসামীদেরকে চিনিও না। তবে আমাকে সাইফুল ইসলাম গাছে বেঁধে মারপিট করেছে, তাকে চিনি।

ওসি রেজাউল করিম বলেন, ওই মামলায় চার্জশীট দেয়া হয়েছে। আর কোন আসামী জামিনে থাকলে পুলিশ তো সেখানে যাওয়ার কথা নয়। ৫ পরিবারের ২০ সদস্য বাড়ীতে নেই, এ রকম কথা শুনিনি, অভিযোগও পাইনি।

(জিকেবি/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৭)