মো. আতিকুর রহমান : রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনের প্রাক্কালে নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দল ও পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসম্মুখে প্রকাশের যে অঙ্গীকার সংসদে যে বিল উত্থাপন করা হয়েছিল তা ক্রমেই ধূসর হয়ে যাচ্ছে।

বিগত সময়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলি প্রত্যেকেই উক্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে, যা দুঃখজনক। এতে একশ্রেণীর জনগণ রাতারাতি অবৈধ পন্থায় কালো টাকার পাহাড় গড়ছে, বিদেশে টাকা পাড়ি জমাচ্ছে অন্য দিকে আর এক শ্রেণী অনাহারে অর্থ কষ্টে মনোবতর জীবনযাপন করছে। ফলে নির্বাচনের ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতির সুফল থেকে জনগণ যেমন বঞ্চিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ধারা তীমিরেই রয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি সেক্টরে ভয়াবহ কালো বিড়ালের আবির্ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও বলতে দ্বিধা নেই, নির্বাচনে জয়ী সকল ক্ষমতাসীন দলগুলি তাদের বিরোধী দলের দুনীর্তির শ্বেতপত্র প্রকাশে যতটানা তারা আন্তরিক থাকেন, ততটা মনোযোগ দেন না নিজের ও দলের সদস্যদের সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে। কিন্তু যদি ক্ষমতাসীন দলগুলি উক্ত কাজটি নিজ নিজ সরকারের আমলে বাস্তবায়ন করতে পারতো তবে দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ অনেকটা প্রশস্ত হতো।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ক্ষমাসীনদলগুলি নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিজ দলের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্যসহ তাদের নিজ নিজ আত্মীয় স্বজন এবং উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারকদের সম্পদের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশের যে অঙ্গীকার করেছিল তা যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো তবে এ সরকারের অনেক সাফল্যের পাশে উক্ত সাফল্য জাতির সামনে মাইলফলক হয়ে থাকতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সরকারি ও বিরোধীদলের চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত সংসদে উত্থাপিত উক্ত বিলটি অনুমদিত হয়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তথ্য মতে, বর্তমান সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উক্ত বিলটি অনুমোদনের জন্য বারবার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

সংবাদপত্রের তথ্য মতে, বিগত বছরের ৪ঠা জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইনকাম ট্যাক্স রিটার্নের ভিত্তিতে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্যদের সম্পদের হিসাব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। যদিও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খয়রুল হক তার সম্পদের হিসাব রাষ্ট্রপতির কাছে এবং বেশকিছু বিচারপতি তাদের সম্পদের হিসাব প্রধান বিচারপতির কাছে জমা দিয়েছেন। যা দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুগান্তরকারী পদক্ষেপ বলে মনে করি। আমরা আশা করবে সরকার নিজ দলের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য ও নেতা-নেত্রীদের সম্পদের হিসাব জাতির সামনে প্রকাশ করে তার সরকারের সাফল্য অর্জন ইতিবাচক ভুমিকা রাখবেন এবং দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের এই গৃহিত উদ্যোগটিকে জাতির সামনে মাইলফলক করে রাখবেন। যদিও ইতিমধ্যে সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের বেশকিছু ব্যক্তি ও মন্ত্রীদের দ্বারা নানাবিদ অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনা জাতির সামনে সরকারের অনেক সাফল্যকে স্মান করেছে, ঠিক তেমনি কিছু কিছু মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অবৈধ সম্পদের বিরুদ্ধে সরকারের দৃঢ় অবস্থান জাতির সমানে সরকারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেছে, যা ইতিবাচক বলে মনে করি। নিজ দলের নেতানেত্রীদের দুনীর্তির ও অবৈধ সম্পদের বিরুদ্ধে সরকারের এই দৃঢ় অবস্থান আগামিতেও অব্যাহত থাকবে এমনটিই প্রত্যাশা করি।

যদিও এদেশে যে কোন সরকারের শাসন আমলে বিভিন্ন সেক্টরে দীর্ঘদিনের লালিত বিরাজমান হাজারো জটিল সমস্যা পাঁচ বছর সময়কালের মধ্যে সমাধান করা সম্ভব নয়। তবে উক্ত সমস্যা সমাধানে সরকার কতটুকু আন্তরিক সেটিই আসলে দেখার বিষয়। জনগণের সার্বিক মঙ্গলে সরকার কতটুকু জনদাবী পূরণে সচেষ্ট থেকেছে সেটিই আসলে দেখার বিষয়। এদেশে বিভিন্ন সেক্টরে ভয়াবহ দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দেশি-বিদেশী নানান ষড়যন্ত্র ও তাদের অসহযোগিতা, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অর্থ দানের ক্ষেত্রে হাজারো শর্ত ও সময়ক্ষেপন, বিভিন্ন সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত দলীয় কর্মকর্তাদের দ্বারা কর্মক্ষেত্রে অসহযোগিতা, দলের অভ্যন্তরে সুবিধাবাদিদের দৌরাত্ম, দলীয় নেতা কর্মীদের ঔদ্ধত্য এবং সরকারের ভাল কাজের প্রচারের চাইতে মন্দ কাজের প্রচার বেশি হওয়ার কারণে সকল সরকারের আমলেই সরকার প্রধানদের কম বেশি ব্যর্থতার গ্লানি বহন করতে হয় এ কথা সত্য। তবে এক্ষেত্রে কোন সরকারের ব্যর্থতার পাল্লা কত বেশি ভারি সেটাই আসলে মূখ্য। যদিও এদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনের পূর্বে নিজেদেরকে জনগণের ভাল সেবক আখ্যায়িত করতে গিয়ে সম্ভব-অসম্ভবের নানান অঙ্গীকারনামা নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকাশ করেন, যা মোটেও সমীচীন নয় । এর ফলে নির্বাচনে জয়ী ক্ষমতাসীন দলের ইশতেহারে উল্লেখিত মিথ্যা আশ্বাসের অঙ্গীকারগুলি বাস্তবায়নের সমর্থ না থাকার কারণে ক্ষমতার শেষ মুহুর্তে ক্ষমতাসীন দলকেই বেশী বেকায়দায় পরতে হয়। ফলে সরকারের পাঁচ বছরে রাষ্ট্র পরিচালনায় অধিক সাফল্য অর্জন করলেও ইশতেহারে মিথ্যা আশ্বাসের ঐসব অঙ্গীকারগুলি গৃহীত সকল সাফল্যকে ম্লান করে দেয়। এই সুযোগে দেশের বিভিন্ন মহল ও বিরোধীদলগুলি সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ব্যর্থতাকে পুঁজি করে বিভিন্ন পন্থায় সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করে। যা সরকারের সাফল্যের পিছনে প্রধান অন্তরায় বলে মনে করি। তাই ক্ষমতার লোভে বৃহত্তর দলগুলি মিথ্যা আশ্বাসের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষনা না করাই শ্রেয় বলে মনে করি। এই ক্ষেত্রে জনগণের চাওয়া-পাওয়র ও দাবীর প্রেক্ষিতে যতটুকু বাস্তবায়ন করা সম্ভব ততটুকুই দাবী আদায়ের প্রতিশ্রুতি করাই শ্রেয় বলে মনে করি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলির কাছে দেশবাসী এমনটিই প্রত্যাশা করেন।

এ দেশবাসীর প্রত্যাশা ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত ভিশন ২০২১ ও সুশাসন বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলেন তা বাস্তবায়নে অধিক সচেষ্ট হবেন। বাকি সময়ের মধ্যে জনগণের বিভিন্ন প্রত্যাশিত দাবি পুরণ এবং কপালে কেলেঙ্কারির যে কালিমা রয়েছে তা নিরুসনে আরো উদ্যোগী ভুমিকা পালন করবেন। পাশাপাশি সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার মনোন্নয়ন এবং জনদুর্ভোগ রোধে অধিক দৃষ্টি দেবেন। গৃহীত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ধারাকে অব্যাহত রেখে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এই প্রত্যাশা দেশবাসীর।
লেখক : কলামিস্ট
(এএস/জুন ২৯, ২০১৪)