চাঁদপুর প্রতিনিধি : বিবাহের মাত্র ৪৮ দিনের মাথায় স্বামীর বাড়ির চার তলায় ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে এক নববধূ। ঘরে তখন ছিলেন শুধু বৃদ্ধা শাশুড়ি। শ্বশুর এশার  নামাজ আদায় করতে এলাকারই মসজিদে গেছেন। স্বামী ছিলেন তার কর্মস্থল ঢাকায়। একাকী ঘরে এমন কী হয়েছে যে কাউকে কিছু না বলেই সে তৃতীয় তলার ফ্ল্যাট স্বামীর ঘর থেকে বের হয়ে চার তলার উপর ছাদে গিয়ে লাফিয়ে নিচে পড়ে আত্মহত্যা করলো। এমন প্রশ্ন এলাকার এবং  যারা ঘটনা শুনেছে তাদের সকলের মুখে মুখে।

ঘটনাটি ঘটেছে ১৩ সেপ্টেম্বর বুধবার রাত আনুমানিক ৯টার সময় চাঁদপুর শহরের ট্রাক রোডস্থ বটতলা খান সড়ক এলাকায়। এ এলাকার আলহাজ্ব এম এ তাহেরের (৭০) একমাত্র পুত্র জিয়াউল হক মামুনের (৩০) স্ত্রী রাহী আক্তার (২৬) এ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটায়।

এই প্রতিবেদক ঘটনায় রাত প্রায় সাড়ে ১১ টায় দিকে ঘটনাস্থলে যান। তখন চাঁদপুর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুবুর রহমান মোল্লা এবং পার্শ্ববর্তী ১২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জিএম শাহজাহান ও ঘটনাস্থলে যান।

ঘটনাস্থলে গিয়ে এলাকাবাসী এবং ওই বাড়ির ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে জানা যায়, রাত প্রায় ৯টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার একেবারে প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পাওয়া না গেলেও আশপাশের লোকজন থেকে জানা গেছে, ওই বাড়ির কাছেই একটি দোকানে তখন কিছু লোক বসা ছিলো। হঠাৎ তারা উপর থেকে কী যেনো পড়ার শব্দ পান। শব্দ শুনেই তারা এগিয়ে গিয়ে দেখেন একজন নারী বাড়ির (এমএ তাহেরের) গেটের সামনে পড়ে আছে। আর তার নাকে মুখে রক্ত ঝরছে। কেউ কেউ বলেছেন ওই মেয়ের নিন্মাঙ্গ দিয়েও রক্ত ঝরেছে। তখন লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচিতে তৃতীয় তলা থেকে বৃদ্ধা শাশুড়ি চিৎকার করতে করতে দৌড়ে নিচে নামেন। তখন ওই বাড়ির নিচতলায় ভাড়াটিয়াসহ অন্য ভাড়াটিয়ারাও দৌড়ে নিচে আসেন। পরে এলাকার কয়েকজন রক্তাক্ত অবস্থায় ওই নারীকে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নিলে কর্মরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একই সময় নিহত গৃহবধূ রাহী আক্তারের শ্বশুর এম এ তাহেরকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ঘটনা দেখে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং অসুস্থ হয়ে যান।

মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুবুর রহমান মোল্লা এবং অন্য এক এসআইসহ পুলিশ ফোর্স ঘটনাস্থলে গিয়ে নানা আলামতের ছবি তোলেন। রাত সাড়ে ১১ টায় গিয়ে ঘটনাস্থলে ছোপ ছোপ রক্ত দেখা গেছে। আশপাশের লোকজন এবং বাড়ির ভাড়াটিয়াদের সাথে কথা বলে নিহত রাহী আক্তারের শ্বশুর শাশুড়ি, স্বামী মামুন সম্পর্কে খারাপ কোনো মন্তব্য পাওয়া যায় নি। সবাই একবাক্যে ভালোই বলেছে।

বুধবার রাত আনুমানিক সাড়ে ১২ টার দিকে নিহত রাহী আক্তারের বাবা, মামা, চাচাতো ভাইসহ আত্মীয়স্বজন হাসপাতালে আসেন। তখন স্বজনরা রাহী আক্তারের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তখন তারা দাবি করেন তাদের মেয়ে রাহী আত্মহত্যা করে নি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া বিয়ের এই অল্প ক’দিনে নানা বিষয়ে শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে মানসিক নির্যাতন করেছে বলেও রাহীর আত্মীয় স্বজন হাসপাতালে বলতে থাকেন।

রাত প্রায় সোয়া ১টার দিকে নিহত রাহীর লাশ হাসপাতাল থেকে মডেল থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরে রাহীর শ্বশুর এম এ তাহেরকেও হাসপাতাল থেকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মডেল থানায় গিয়ে রাহীর শ্বশুর এম এ তাহেরকে ডিউটি অফিসারদের রুমে বসা দেখতে পান। তখনও তাকে কিছুটা অসুস্থ মনে হয়েছে। তখন এই প্রতিবেদক তার কাছ থেকে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এটুকু বলেন যে, আমি শাহী মসজিদে এশার নামাজ জামাতে আদায় করে নামাজ শেষে বাসায় ফিরছি। বাসার গেটের কাছাকাছি আসামাত্রই আমার সামনে উপর থেকে ভারী কী যেনো পড়লো। এগিয়ে দেখি আমার বউমা-এ কথা বলেই তিনি কেঁদে দিলেন। তখনই তিনি চিৎকার দেন। এরপরই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান।

এম এ তাহেরের মেয়ের জামাতা জানান, মামুন ও রাহীর শুভ বিবাহ পারিবারিক আয়োজনে গত ২৮ জুলাই ২০১৭ খ্রিঃ তারিখে হয়। রাহীদের বাড়ি হাজীগঞ্জের টোরাগড় এলাকায়। তার পিতার নাম মমিন হোসেন ভূঁইয়া। এক ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। বিয়ের দিনই রাহীকে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। হাসি খুশিভাবেই তাদের সংসার চলছে। মামুন ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরি করেন। বিয়ের ক’দিন পর মামুন চাকুরিতে চলে যান। ঈদের ছুটিতে মামুন বাড়িতে এসেছে। ঈদের পর বউসহ (স্ত্রী রাহী আক্তার) শ্বশুর বাড়ি বেড়াতেও গেছে। ঘটনার ২/৩ দিন আগে মামুন তার স্ত্রীকে শ্বশুর বাড়ি থেকে এনে নিজেদের বাড়িতে রেখে ঢাকা চলে যায়। ২ দিন পরই তার স্ত্রী আত্মহত্যার ঘটনা ঘটালো।
এদিকে গতকাল নিহত রাহীর শ্বশুর বাড়ির লোকজন জানান, তারা বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছেন রাহীর সাথে তার এক চাচাতো ভাইয়ের প্রেম ছিলো। সে চাচাতো ভাই ঘটনার পর রাতে হাসপাতালে এসে খুব বেশি উন্মাদনা দেখিয়েছে। যা সচরাচর আপন ভাইয়ের বেলায়ই দেখা যায়। এই চাচাতো ভাই হাসপাতালে রাহীর পিতাকে মারার জন্য কয়েকবার তেড়ে গেছে এবং বলেছে তুই (রাহীর পিতাকে) তোর মাইয়্যাকে ডাকাইতের কাছে বিয়া দিছছ। আইজ তোরে মাইরালামু। জীবনে মামলা বহু খাইছি, দরকার হয় আরেকটা মার্ডার মামলা খামু।’ এই চাচাতো ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এবং রাহীর সর্বশেষ মোবাইলের কথোপকথন যাচাই করলে হয়ত কোনো রহস্য বের হয়ে আসতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

গতকাল নিহত রাহীর লাশ ময়না তদন্ত করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা গেছে, নিহত রাহী আক্তারের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। আর তার শ্বশুর এম এ তাহের তখনও থানা হেফাজতে ছিলো।

(ইউএইচ/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৭)