প্রবীর বিকাশ সরকার : [ভূমিকা : আমার ৫৫ বছরের জীবনে বাবার সঙ্গে কেটেছে মাত্র ২৪-২৫টি বছর! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যেভাবে বাবাকে দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি এবং বুঝেছি তার মূল্যায়নই হচ্ছে এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বা স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’---এমন করে খোলামেলা খুঁটিনাটি কোনো স্মৃতিকথা আর কোনো বাঙালি লিখেছেন তার জন্মদাতা পিতৃদেবকে নিয়ে আমার অন্তত জানা নেই।]

আমার পরম পূজনীয় পিতা ৩১ বৈশাখ, সোমবার ১৪১৯ (১৪-৫-২০১২) তারিখে স্বর্গবাসী হয়েছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। এই শহরের একজন প্রাচীন মানুষ বলা যায় বাবাকে। তাঁর সমবয়সী মানুষ এখন হাতেগোনা। আর তাঁর সহকর্মীও মাত্র কতিপয় কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন বলেই জানি।

বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েই সঙ্গেসঙ্গে ছুটে আসে আমার বন্ধুরা বিজন দাস, সৈয়দ আহমাদ তারেক, খায়রুল আলম খসরু, গাজী মোহাম্মদ ইউনূস, শরীফ আহম্মদ অলী, বিষ্ণু সাহা, আহম্মদ আলী মিটন, জমিরউদ্দিন জম্পি, জিয়াউল হক স্বপন, ইকরামুল হক তিতাস, ফখরুল হুদা হেলাল, আনিছুর রহমান, খায়রুল আনাম রায়হান, শহীদুল হক স্বপন, আরিফুল হাসান প্রমুখ যারা বাবাকে দেখে আসছে তাদের কৈশোর থেকে।

বাবার সঙ্গে দীর্ঘদিন সম্পর্কযুক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন কুমিল্লা জজকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অজিতকুমার চৌধুরী, পুলিশ অফিসের অবসরপ্রাপ্ত রিডার ঠাকুর জিয়াউদ্দিন আহমদ, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার সঞ্জিত পাল এবং তরুণ অফিসার রিপন। উল্লেখ্য যে, জিয়াউদ্দিন সাহেবের পিতা মরহুম শফিউদ্দিন ঠাকুরও ছিলেন রিডার---তাঁর সঙ্গেও ছিল বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। শফিউদ্দিন সাহেবের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন ঠাকুর জিয়াউদ্দিন তাঁর সঙ্গেও বাবার কর্মক্ষেত্রে সম্পর্ক ছিল প্রায় ২০ বছর। তাঁরা বাবার জীবন ও কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে স্মৃতিকাতর হয়ে অনেক গল্প করলেন। স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে আমাদের পারিবারিক শুভাকাঙ্খী সুকুমার দাস কাকাবাবু, নিকুঞ্জমোহন দাস, গৌরাঙ্গচন্দ্র দাস মেসোমশাইরাও বাবার স্মৃতিচারণ করে অশ্রুসিক্ত হলেন। স্থানীয় অনেকেই এসে শেষবার বাবার মুখ দেখে গেছেন। অনেকেই ফোন করে সমবেদনা জানিয়েছেন। বাবার সঙ্গে দীর্ঘসময় চাকরি করেছেন ডিবি অফিসার চাণক্য চন্দ আসতে পারেননি সমবেদনা জানিয়েছেন। তাছাড়া আত্মীয়স্বজনতো এসেছেনই, দূর-দূরান্ত থেকে টেলিফোনে জানিয়েছেন সমবেদনা।

শববহন থেকে শ্মশানের শেষকৃত্য পর্যন্ত সঙ্গে ছিল বিষ্ণু, টিটন, শান্টু, টিটন ধর; হেলালভাই, তারেকভাই, অলীভাই, আরিফ এবং বিজনদা। বন্ধুবর শাহ্জাহান চৌধুরী বাসায় আসতে না পারলেও শ্মশানে গিয়েছিলেন। স্থানীয় বন্ধু খোরশেদভাই তার গাড়ি নিজে চালিয়ে লোকবহনে সহযোগিতা করেছেন। হিন্দু সৎকার সংঘের প্রধান কর্মকর্তা খ্যাতিমান সাদা মনের মানুষ কানু দত্তের অনুগত কর্মীরা যে সম্মান দিয়ে বাবার সৎকারের দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদেরকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। চন্দন নাগ যে আমাদের আত্মীয়র চেয়েও বেশি তার অবদান ভুলবার নয়। শববহনের জন্য আনুষাঙ্গিক কেনাকেটা এবং আয়োজন সমস্ত সেই করেছে। অনেক বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন আসতে পারেননি নানা কারণে ফোন করেছেন আমাকে। সমবেদনা জানিয়েছেন। আমি জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে সকলের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

এই যে এত মানুষ ছুটে এসেছেন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করেছেন, সমবেদনা জানিয়েছেন ও শোক প্রকাশ করেছেন এ সমস্তকিছুই বাবার প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। মানুষ যে তাঁকে এতখানি ভালোবাসত জানা ছিল না আমার! আমি এবং পরিবারের সবাই অভিভূত! ঢাকা জাদুঘরের প্রাক্তন মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক সমর পাল লিখেছেন, ‘অনেক গল্প শুনেছি এই প্রগতিশীল মানুষের। অনেক দিয়েছেন জীবনভর, নিয়েছেন শুধু ভালোবাসা।’

এই হেন আমার বাবার ইতিহাস বাবা লিখে রেখে যায়নি বহুবার আমি অনুরোধ করা সত্ত্বেও। লিখলে যে কত ঘটনা ও ইতিহাস উঠে আসত বৃহত্তর কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রামে অতিবাহিত দীর্ঘজীবনের---যা হতো একটি মহাভারত। কাছে থেকে দূরে থেকে যারা বাবাকে দেখেছেন, জেনেছেন ও চিনেছেন তাঁদের কথা আমার কর্ণগোচর হয়েছে খুবই কম। পিতাপুত্র হিসেবে আমি বাবাকে কিভাবে দেখেছি এবং বাবা আমাকে কিভাবে দেখেছে জন্মের পর থেকে ২৪ বছর পর্যন্ত সেই ইতিহাস লিখে রাখার তাগিদ অনুভব করলাম এই কারণে যে, এই মানুষটি সামান্য একজন মানুষ হলেও তাঁর চিন্তা, ভাবনা ও চেতনাবোধ অসাধারণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে আমার দৃষ্টিতে। বোধকরি আরও অনেকেরই চোখে। যাঁরা এই আত্মজৈবনিক ইতিহাস ধৈর্য ধরে পাঠ করবেন আশা করি একমত হবেন।............. চলবে

লেখক : জাপানপ্রবাসী

(এএস/জুন ২৯, ২০১৪)