প্রহলাদ মন্ডল সৈকত, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) : বানত সইগ ভাসি গ্যাছে। তাই চাইল কিনি খাওয়া নাগে। চাইলোত আগুন নাগছে বাহে। কয়দিন আগোত ৩৩ট্যাকা করে চাইল কিনলুং। আজক্যা সে চাইল পঁয়তাল্লিশ টাকা চায়। দ্যাশত আগুন নাগছে মনে হয়।

সোমবার চাল কিনতে আসা বানভাসী মোহাম্মদ আলী (৭৫) ক্ষোভে এ কথাগুলো বলেন। তার বাড়ী উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের কালুয়ার চর এলাকায়। কিছুদিন আগে স্বরণকালের ভয়াবহ বন্যায় তার বাড়ীর সবগুলো ঘর ভেসে যায়। সেই সাথে ঘরের ধান চাল থেকে শুরু করে আসবাবপত্রও ভেসে যায়। নিঃস্ব হয়ে পড়ে সে। পরে বন্যা পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রতি অনুযায়ী সরকারীভাবে মাত্র (এক)১ বান্ডিল টিন পেয়েছে।

মোহাম্মদ আলী আরো বলেন, শ্যাখের বেটি কয়া গ্যালো টিনের ঘর তুলি দ্যাবে। কয়জন নোক আসি মোক ৮খান টিন দিয়া গ্যালো। বাঁশ ক্যানার ট্যাকাও নাই। ঘর তুলবার পাং নাই। এমননি ছাপরা তুলি থাইকপ্যার নাকছি। এলা তো চাইল কিনব্যারও ট্যাকা নাই। তাতে তো চাইলত আগুন ধোরছ্যা।

শুধু মোহাম্মদ আলী নয়, চালের বাজারে চাল কিনতে আসা মানুষদের একই কথা। এক সময় কুড়িগ্রাম মঙ্গার দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। আশ্বিন-কার্তিক মাস আসলেই শুরু হয় মঙ্গা। এমনকি সারা বছরেই এ অঞ্চলে মঙ্গা লেগে থাকতো। নিন্ম আয়ের মানুষ ও দরিদ্র পরিবারগুলো জঙ্গল ও রাস্তার কঁচু-ঘেঁচু সিদ্ধ করে খেয়ে জীবন যাপন করত। পত্র- পত্রিকায় আসা এ খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে অনেকের সহযোগীতায় ধীরে ধীরে মঙ্গা দুর হয়ে যায় এ অঞ্চল থেকে। মঙ্গা নামক শব্দটি মুছে যায়।

এ বছর স্বরণকালের ভয়াবহ বন্যায় সব কিছু ভেসে গেলে বানভাসি মানুষরা আবারো মঙ্গার আনাগোনা দেখতে পায়। কিন্তু বর্তমান সরকারসহ দেশ- বিদেশের বিত্তবানরা এগিয়ে আসায় ওই সব বন্যাকবলিত মানুষরা খাদ্যের অভাব তেমন বুঝতে পারেনি। কিন্তু দেশে চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠায় আবারো দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও নিন্ম আয়ের মানুষ নতুন করে মঙ্গার পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষরা চালের বাজার নিয়ন্ত্রন রাখতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তা না হলে চালের বাজার যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে প্রতি কেজি চালের দাম একশত টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে।

সোমবার রাজারহাট বাজার সহ উপজেলার বেশ কয়েকটি হাটে গিয়ে জানা যায়, মোটা চাল সর্বনিন্ম ৪২ টাকা দরে এবং মিনিকেট চাল সর্বোচ্চ ৬৫ টাকায় বিক্রি করছে চাল ব্যবসায়ীরা। ফলে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠেছে। কয়েক দিন আগে মোটা চাল ২৮ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হলেও এক লাফে প্রায় দ্বিগুন হওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। যেহেতু বাঙ্গালীরা মাছে ভাতে অভ্যস্ত। সে কারণে বাধ্য হয়েই তাদের দ্বিগুণ মূল্য দিয়ে চাল কিনতে হচ্ছে। কি কারণে চালের দাম এত বেশী হয়েছে, সেটাও সঠিকভাবে বলতে পারছে না চাল ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা জানান, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পর থেকে চালের বাজার চড়া হয়ে উঠেছে। তারা বস্তা প্রতি দিগুণ মূল্যে কেনার কারণে তাদেরকেও দিগুণ দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তাদের কিছু করার নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।

রাজারহাট বাজারের চাল ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মিনিকেট চাল প্রতি কেজি ৬০ টাকা থেকে ৬৫ টাকা, আটাশ চিকন চাল প্রতি কেজি ৫৭ টাকা থেকে ৬০ টাকা, স্বর্ণা চাল প্রতি কেজি ৪৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা এবং হাই ব্রিড ধানের চাল (মোটা) প্রতি কেজি ৪২ টাকা থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সচেতন মহল মনে করে চাল ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করায় চালের মূল্য উর্ধ্বগতি হয়ে উঠেছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা মোঃ খয়বর আলী জানান, রাজারহাট উপজেলায় বাজার মনিটরিং কমিটি নাই। তবে জেলাগুলোতে রোববার(১৭ সেপ্টেম্বর) থেকে ওএমএসএস এর চাল খোলা বাজারে বিক্রি শুরু হয়েছে। কিন্তু উপজেলা গুলোতে (১৮ সেপ্টেম্বর) সোমবার পর্যন্ত কোন নির্দেশনা আসে নাই।

(পিএমএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭)