আন্তর্জাতিক ডেস্ক : নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি ১৫ বছর গৃহবন্দি ছিলেন; রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। গত মাসে রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশন অভিযানে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে।

রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তা ও বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে মার্জিত ইংরেজিতে দেয়া আধা-ঘণ্টা ভাষণে সু চি বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া মুসলিমদের সামাজিক স্বীকৃতির বিষয়টি যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদেরকে ফেরত নেয়ার প্রস্তাব করেছেন। একই সঙ্গে যাচাই-বাছাইয়ে যারা উতড়ে যাবেন তাদেরকে ফেরত নিয়ে পুনর্বাসনের প্রস্তাবও এসেছে তার বক্তব্যে। তবে রাখাইনের সহিংসতায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও বক্তৃতায় একবারের জন্য ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উল্লেখ করেননি সু চি।

মঙ্গলবারের ভাষণে সু চি বলেন, এই পলায়নের ঘটনা কেন ঘটছে আমরা তার কারণ খুঁজে বের করতে চাই। যারা পালিয়ে গেছে আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তিনি বলেন, কূটনীতিকরা রাখাইন সফর করতে পারবেন।

তিনি বলেছেন, সব বাসিন্দার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ আছে। সু চির এই দাবি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে।

গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে মিয়ানমার পুলিশের ৩০টি পোস্ট ও সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্পে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এই হামলার প্রতিক্রিয়া ছিল যৌথ শাস্তি। স্যাটেলাইটে সংগৃহীত ছবি বিশ্লেষণের পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, রাখাইনে কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত, অনেকেই ধর্ষণের শিকার ও অনেক ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সেনাবাহিনীর সঙ্গে সু চির স্পর্শকাতর সম্পর্ক রয়েছে। অর্ধ শতাব্দি ধরে দেশ শাসন করে আসা মিয়ানমার সেনাবাহিনী সু চিকে ১৫ বছর গৃহবন্দি করে রেখেছিল। সু চি যখন মিয়ানমার ডি ফ্যাক্টো নেতা, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন; ঠিক সেই সময় দেশটির প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র, সীমান্ত নিরাপত্তা ও পুলিশের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। বেসামরিক সরকারের নেয়া পদক্ষেপে ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে সেনাবাহিনীর। আর সেজন্য প্রত্যেকটা শব্দই সু চিকে উচ্চারণ করতে হচ্ছে দেখে শুনে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে অত্যন্ত সাবধানে চলতে হচ্ছে সু চিকে। রোহিঙ্গাদের জন্য দেশটিতে জনগণের সহানুভূতি একেবারেই তলানিতে। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয় বলে সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি আছে, অধিকাংশ বার্মিজ জনগণও তাই মনে করে। এমনকি কয়েক প্রজন্ম ধরে এই রোহিঙ্গাদের অনেকেই দেশটিতে বসবাস করে এলেও অনেকেই তাদেরকে অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী মনে করে।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং ক্লিয়ারেন্স অপারেশনকে ১৯৪২ সালের আগের একটি সমস্যা শেষ করার জন্য চালানো হচ্ছে বলে কয়েকদিন আগেই উল্লেখ করেছেন।

এছাড়া মিয়ানমারের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল পূর্ববর্তী সামরিক সরকারের আমলে। এই সামরিক সরকার ১৯৬২ সাল থেকে শাসন ক্ষমতায় ছিল। ২০০৮ সালে অবিশ্বাস্য এক গণভোটের মাধ্যমে এই সংবিধানের অনুমোদন দেয়া হয়। সেসময় সংবিধানের এই অনুমোদনে সু চি কিংবা তার দল এনএলডির কোনো সায় ছিল না।

সেনাবাহিনী ঘোষিত ‘বিকাশমান শৃঙ্খল গণতন্ত্র’র পরিকল্পনা নিশ্চিত করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। সংবিধানের এই সংশোধনীর আওতায় সংসদের এক চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়।

শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের ১১টি আসনের মধ্যে ছয়টি আসনেও রয়েছে সেনাবাহিনী মনোনীত ব্যক্তিরা। গণতান্ত্রিক সরকার বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে এই পরিষদের। অনেক শীর্ষস্থানীয় পদের দখল করে আছেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা। সেনাবাহিনীর ব্যবসায়ীক স্বার্থও রয়েছে। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা খাতের যৌথ বাজেটের চেয়েও ১৪ শতাংশ বেশি ব্যয় হয় প্রতিরক্ষা খাতে। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেনাবাহিনী এবং সু চির অবস্থান ছিল তীব্র পরস্পরবিরোধী।

গত ৭০ বছর ধরে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সীমান্তে বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে শান্তি আলোচনা নিয়েও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভেদ আছে। তবে তারা অর্থনৈতিক সংস্কার, উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে একমত। সু চির জনপ্রিয় মন্ত্র হচ্ছে ‘আইনের শাসন’। একই সঙ্গে দেশটিতে দ্রুত পরিবর্তনের কারণে সামাজিক উত্তেজনাও বাড়ছে।

দীর্ঘ নীরবতা ও সমালোচনার মুখে সু চি তার ভাষণে বলেছেন, তিনি বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিতে চান যে, তার সরকার মাত্র ১৮ মাসের কম সময় ক্ষমতায় অাছে, মানুষ আশা করে, সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা হবে অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান কমিশন নেতৃত্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুসরণ করবে।

কফি আনান তার সুপারিশে বলেছেন, যদি রাখাইনের সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জ শিগগিরই মোকাবেলা করা না হয় তাহলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মৌলবাদের প্রকৃত ঝুঁকি তৈরির শঙ্কা রয়েছে। কফি আনান নেতৃত্বাধীন ৯ সদস্যের তদন্ত দলের ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদেরকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রহীন সম্প্রদায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই-কমিশনার জেইদ বিন রাদ আল-হুসেইন রাখাইনের সহিংস পরিস্থিতিকে জাতিগত নিধনে পাঠ্য বইয়ের উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। জেইদের এই মন্তব্যের ব্যাপারে জাতিসংঘের মহাসচিবকে প্রশ্ন করা হলে অ্যান্তোনিও গুতেরাস বলেন, এক তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে; তখন এটাকে বর্ণনা করার জন্য কি আপনি এর চেয়ে ভালো কোনো শব্দ খুঁজে পাবেন?

মঙ্গলবার জাতিসংঘে মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে রুদ্ধ দ্বার বৈঠক করেছেন ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরিস জনসন। বৈঠকে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালিও উপস্থিত ছিলেন। এক বিবৃতিতে বোরিস জনসন রাখাইনের সহিংসতা বন্ধ ও শিগগিরই সেখানে মানবিক ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানান।

গত বুধবার রাখাইনের সহিংসতা নিয়ে প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা পরিষদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। শিগগিরই রাখাইনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও বেসামরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানায় নিরাপত্তা পরিষদ। সেখানে চলমান সেনা অভিযান অবসানের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে। তবে রাখাইনের এই সহিংসতার ঘটনাকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ইস্যু বলে পাশে দাঁড়িয়েছে চীন।

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সীমান্ত আছে ভারত, বাংলাদেশের। পূর্বে আছে থাইল্যান্ড ও লাওস; উত্তর-পূর্বে আছে চীন। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর। ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে অধিকাংশই বৌদ্ধ। এদের মধ্যে ২০ লাখ মুসলিম আছেন; যাদের অধিকাংশই রাখাইনে বসবাস করেন।

(ওএস/এসপি/সেপ্টেম্বর ১৯, ২০১৭)