E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

শিরোনাম:

উপকূলের শিক্ষা-৯

‘এই স্কুলে কি আর আমরা পড়তে পারমু’

২০১৮ ফেব্রুয়ারি ১০ ১৫:১৮:১৪
‘এই স্কুলে কি আর আমরা পড়তে পারমু’

মিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী তাজমীম ( রোল নং ১)। বড় দুই বোনের মতো এবার পিএসসি পরীক্ষা দিয়ে আগামী বছর উচ্চতর বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করবেন এই স্বপ্ন নিয়ে বছরের প্রথম দিন থেকেই মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করে। কিন্তু নতুন বই পাওয়ার মাস না পেরোতেই তাকে শুনতে হয়েছে দুঃসংবাদ। শুধু শৈশবের স্মৃতি ঘেরা চাড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় না, তাকে হয়তো এ বছরই ছেড়ে যেতে হবে বাল্যকাল থেকে বেড়ে ওঠা প্রিয় ঘর, গ্রাম, বন্ধু, স্বজন কে।

কলাপাড়ার চাড়িপাড়া গ্রামের এই স্কুল ছাত্রীর মতো শতশত স্কুল ছাত্র-ছাত্রীকে এ বছর লালুয়া ইউনিয়ন ছেড়ে যেতে হবে। সরকার পায়রা বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য শতশত পরিবারকে ৭ ধারা নোটিশ প্রদান করেছে। এসব পরিবার পূর্নবাসন সহায়তা ও তাদের জমির মূল্য দেয়া হবে এই শর্তে এ জমি অধিগ্রহণ করে সরকার।

এই নোটিশ পাওয়ার পর রামনাবাদ নদী ঘেরা এ লালুয়া ইউনিয়ন জুড়ে চলছে প্রতিটি পরিবারে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা। তাদের চিন্তা কোথায় কিভাবে নতুন আবাস গড়বেন। কোথায় ভর্তি করবেন তাদের সন্তানকে। যদিও সরকার তাদের জমির ন্যায্য মূল্য পরিশোধ করবে।

একই ভাবে চিন্তিত ধানখালী ইউনিয়নের গন্ডামারি ও উত্তর নিশান বাড়িয়া গ্রামের পাঁচ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রীর পরিবার। তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে এই দুই গ্রামে তিন ধারায় নোটিশ করা হয়েছে। আর এ নোটিশ পেয়েই হতবাক তারা। তাই নিজের শেষ সম্বল রক্ষায় আন্দোলনে নেমেছে গোটা এলাকার কৃষক, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীসহ সাধারণ মানুষ।

স্কুল শিক্ষক শওকত আলী জানান, চাড়িপাড়া গ্রামে তাদের শৈশব কেটেছে। তার সন্তানরাও এখানে বড় হয়ে উঠেছে। বড় মেয়ে ডিগ্র্রির ছাত্রী। মেঝ মেয়ে এবার এইচ এস সি পরীক্ষা দিবেন। ছোট মেয়ে চাড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী তাজমীম (রোল নং ১)।

তিনি বলেন, তাজমীম এই স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণীর পিএসসি পরীক্ষা দিতে পারে কিনা এ নিয়ে চিন্তিত। বলেন, আজ (২৯ জানুয়ারি) সরকার জমি অধিগ্রহন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ৭ ধারার নোটিশ পেয়েছেন। এখন সরকারি টাকা উত্তোলনের পর তাকে এই এলাকা ছেড়ে যেতে হবে। এতে এ বিদ্যালয়ের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী স্থানচ্যুত হবে বলে জানান।

চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী জান্নাতী জানায়,এই স্কুলে কি আর আমরা পড়তে পারমু। গ্রামের হগল মানুষ খালি কান্দে। কি যে একটা কাগজ দেছে সরকার। আব্বা-আম্মারও মন ভালো নেই। হগলডি কয়-আমাগো নাকি বাড়ি ছাইড়্যা যাইতে হইবে। লালুয়ার বড় পাঁচ নং ওয়ার্ডের এই স্কুল ছাত্রী রহিম উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে পাশ্ববর্তী মুন্সী পাড়া, বড় পাঁচ নং ও চান্দুপাড়া গ্রামের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী।

চাড়িপাড়া গ্রামের জেলে সবুজ। প্রকৃতি ও জলদস্যুদের সাথে যুদ্ধ করে চাড়িপাড়া গ্রামে একটু চাষের জমি করেছেন। মেয়ে কেয়া এবার চাড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। কিন্তু গতকাল সাত ধারা নোটিশ পেয়ে সে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে টাকা হয়তো সে পাবেন, কিন্তু কোথায় গড়বেন নতুন আবাসস্থল। মেয়ের লেখাপড়া কোথায় করবেন এ চিস্তায় এখন চিন্তিত। তারমতো অবস্থা হাজারো অবিভাবকের।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল কুদ্দুস জানান, শুধু কি এই তিন গ্রাম তারাও ( স্কুল) তিন ধারার নোটিশ পেয়েছেন ( তিন ধারা মানে জমি অধিগ্রহনের জন্য সরকার জমি চিহ্নিত করছে)। বছরের প্রথমই এই নোটিশ (সাত ধারা) পেয়েছে তাঁর স্কুলে ভর্তি হওয়ায় ১১০-১২০ শিক্ষার্থীর অভিভাবক। এ কারণে বছর শেষে এই ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষা জীবন কোথায় গিয়ে দাড়ায় এ চিন্তা তারাও করছেন। কেননা সরকার যেসব এলাকা অধিগ্রহণ করেছে তার মধ্যে অনেক নিঃস্ব, সহায়-সম্পদহীন পরিবার রয়েছে। এই পরিবারগুলো আবাসন তালিকায় নাম উঠলেও তারা কোন ধরনের আর্থিক লাভবান হবে না। এ কারণে এসব পরিবারের ছেলে-মেয়েদের অধিকাংশেরই শিক্ষা জীবন ঝরে পড়ার আশংকা করছেন।

স্কুল ছাত্র রিফাত জানায়, এই গ্রামে কেটেছে আমাদের শৈশব, কৈশোর। স্মৃতিময় গ্রাম প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের ছেড়ে যেতে হবে। মুন্সীপাড়া গ্রামের এই স্কুল ছাত্রের মতো দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজে অধ্যায়নরত। পরিবারের সাথে সাথে প্রতি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনে দাড়ি(।), কমা(,) কিংবা ফুলষ্টপ (.) পড়ার আশংকায় উদ্বিগ্ন পরিবারসহ শিক্ষার্থী নিজেই।

চাড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মো. আজিজুর রহমান জানান, এই বছরের প্রথম মাসে এলাকাবাসী সাত ধারা নোটিশ পেয়ে হতবাক। কেননা কোথায় বিকল্প আবাসন, সন্তানদের লেখাপড়ার স্কুল পাবেন তা তারাও জানেন না। এ বছর বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। যারা সবাই রয়েছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠায়।

এদিকে সহায় সম্পদ রক্ষায় জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বন্ধের দাবিতে গত বছরের শেষের দিকে আন্দোলনে নামে গ্রামবাসীদের সাথে গন্ডামারি ও উত্তর নিশান বাড়িয়া গ্রামের পাঁচ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের পরিবার।

স্কুল শিক্ষিকা মাহাবুবা বেগম মালা বলেন, পাঁচ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে গন্ডামারি ও উত্তর নিশান বাড়িয়া গ্রামে। এই সময়ে জমি অধিগ্রহণ করা হলে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যাবে।

গন্ডামারি গ্রামের মোমেলা বেগম জানায়, মোর মাইয়া মীম ক্লাস এইটে পড়ে। পোলাডা ছোড। এই সময় যদি হগল জায়গা-জমি লইয়া যায় তাইলে বুড়া কালে মোরা কই থাকমু। মোগো তো বাপ-দাদার কবরডাও থাকবে না।

কৃষক আবদুর রশিদ তালুকদার বলেন, পাঁচ শতাধিক বসত ঘর, দুই শতাধিক কবর, সাড়ে চারশ একর চাষের জমি, দুইটি সাইক্লোন সেল্টার, ছয়টি মসজিদ ও তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো অধিগ্রহণ করা হলে প্রায় আট হাজার মানুষ তাদের শেষ সম্বলটুকু হারাবে। তাই তারা এ জমি অধিগ্রহণ ঠেকাতে কঠোর আন্দোলন করবেন। ইতিমধ্যে তারা বিশাল মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে।

কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনি লাল সিকদার জানান, সরকার জমি অধিগ্রহন করলেও জমি অধিগ্রহণ করা এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষত কি হবে এ বিষয়ে তারা কোন সরকারি সিদ্ধান্ত পান নি। সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত নিবে তাঁরা সেভাবেই বাস্তবায়ন করবেন বলে জানান।

লালুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান তারা জানান, জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া প্রায় চুড়ান্ত। যেসব পরিবার সাত ধারা নোটিশ পেয়েছে সেই সব পরিবারকে পূনর্বাসন করার জন্য ইতিমধ্যে সরকার উদ্যেগ নিয়েছে। তবে যেসব শিক্ষার্থী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান করছে বসত ভিটা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকের শিক্ষা জীবন শেষ হওয়ার আশংকা তিনিও করছেন। তবে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে তারা কাজ করবেন বলে জানান।


(এমকেআর/এসপি/ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৮)

পাঠকের মতামত:

০২ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test