E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

প্রশাসনকে জানিয়ে কোন লাভ হচ্ছে না

সুদখোর জলিলের অত্যাচারে বিপন্ন কালীগঞ্জের কয়েকটি সংখ্যালঘু পরিবার

২০২০ ফেব্রুয়ারি ২২ ১৬:৩০:৪০
সুদখোর জলিলের অত্যাচারে বিপন্ন কালীগঞ্জের কয়েকটি সংখ্যালঘু পরিবার

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : এক সুদখোর মহাজনের ফাঁদে পড়ে সর্বশান্ত হতে বসেছে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর গ্রামের কয়েকটি সংখ্যালঘু পরিবার। অবিলম্বে ওই সুদখোরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে ওইসব পরিবারগুলোর সর্বস্ব হারিয়ে রাতের আঁধারেু দেশ ছাড়তে বাধ্য হবে বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।

ফতেপুর গ্রামের চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস জানান, বাঁশতলা বাজারে তার একটি মিষ্টির দোকান রয়েছে। ব্যবসায়ে লোকসান হওয়ায় একই গ্রামের ফজর আলী মোড়লের ছেলে আব্দুল জলিলের কাছ থেকে ২০১০ সাল ও পরবর্তীতে প্রতি হাজারে মাসিক ৪০ টাকা সুদ দেওয়ার শর্তে তিনি কয়েক দফায় সাত লাখ টাকা ঋণ নেন। গ্যারান্টি হিসেবে তার, তার স্ত্রী বাসন্তী ও ছেলে ছিদাম এর কাছ থেকে জনতা ব্যাংকের ১৩টি চেক ছাড়াও ও কয়েকটি অলিখিত নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়। জলিলের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে দিতে না পারায় তাদের প্রতিবেশি শম্ভু বিশ্বাস স্বপরিবারে রাতের আঁধারে দেশ ছেড়ে চলে যান। এতে চিন্তিত হয়ে পড়েন জলিল। একপর্যায়ে শম্ভু সাজিয়ে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কালীগঞ্জ সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের মাধ্যমে ২০১৪ সালে নিজ নামে দলিল করে নেন জলিল।

চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস অভিযোগ করে বলেন, শম্ভু দেশ ছাড়ার পর জলিল তাদের উপর আস্থা রাখতে না পেরে তাকে জমির দলিল বন্ধক রেখে কালীগঞ্জের একটি ব্যাংক থেকে লোন করিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেয়। ওই টাকা দিয়ে সুদাসল ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করে দিলে তাদের ১৩ টিচেক ফেরৎ দেওয়ার কথা বলা হয়। একপর্যায়ে ২০১৬ সালের ২১ ডিসেম্বর তার ও স্ত্রী বাসন্তীকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কালীগঞ্জ সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের দলিল লেখক শফিকুলের ঘরে ডেকে নিয়ে যায় জলিল। ব্যাংকের লোন এর জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র দু’টি নিয়ে কয়েকটি লিখিত কাগজে সাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়।

পরে তারা জানতে পারেন তাদের বসত বাড়ি, কৃষি জমি ও বাঁশতলা বাজারের তিনটি দোকনসহ ৩৬ শতক জমি ৩০ লাখ টাকায় জলিল ও তার আত্মীয় রহিমের কাছে বিক্রির জন্য ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় একটি বায়নাপত্র দলিল(৫১৬৯ নং) করে নেওয়া হয়েছে। তাতে বাকী টাকা পরিশোধ করে ২০১৭ সালের ১৫ জুন এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ দলিল করে দেওয়ার কথা বলা হয়। প্রতিবাদ করায় জমি রেজিষ্ট্রি দলিল করে দিলে ১৩টি চেক ফেরৎ দেবে বলে তাদেরকে জানায় জলিল। চেক ফেরৎ না দেওয়ায় ও বিনা টাকায় বায়নাপত্র দলিল করে নেওয়ার বিষয়টি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জানানোয় ক্ষুব্ধ হয়ে ছেলে ছিদামকে খুন করার হুমকি দেয় জলিল ও তার সহযোগীরা।

চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস আরো বলেন, সহায় সম্বল কেড়ে নিয়ে তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে বিতাড়িত করা হবে এমন আশঙ্কায় তারা ওই জমি, বাড়ি ও দোকান ২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর ছেলে ছিদামের নামে রেজিষ্ট্রি দলিল করে দেন। বিষয়টি জানতে পেরে পরদিন জলিল তাদের নামে আইনজীবীর নোটিশ পাঠান।

একপর্যায়ে তাদের বিরুদ্ধে কালীগঞ্জ সহকারি জজ আদালতে দেঃ ৮/১৮ মামলা করে জলিল ও রহিম। পরে ছিদামকে বিবাদী শ্রেণীভুক্ত করে। তারাও চেক,, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন কাগজপত্র ফেরৎ পেতে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে জলিলের বিরুদ্ধে পিটিশন ১২৯১/১৭ নং মামলা করেন। বৃহষ্পতিবার আদালত তার পক্ষে রায় দিয়েছে। চেক নোটিশ পাওয়ার আট মাস পর জলিল তাদের (চিত্ত) বিরুদ্ধে আদালতে আট লাখ টাকার তিনটি চেক ডিসঅনারের মামলা(১১৩,১১৮.১১৯ নং) করেন।

এরপরও জলিল, রহিম, মামুন, লাকী খাতুন, শফিকুল ও ইউনুছ জমি থেকে গাছ গাছালি কাটতে না দেওয়া, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, ঘরবাাড়ি, জমি ও দোকানঘর জবরদখল করতে দেশ থেকে বিতাড়িত করার হুমকি দেওয়ায় থানায় কয়েকটি সাধারণ ডায়েরী করে ছিদাম। এরপরও হুমকি ধামকি অব্যহত থাকায় গত বছরের ৯ ডিসেম্বর কালীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করা হয়। গত ৪ জানুয়ারি বিষয়টি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেও আজো কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।

সরেজমিনে শনিবার সকালে ফতেপুর গ্রামে গেলে জনাব আলী, সাহেব আলী, আল আমিনসহ কয়েকজন জানান, গরুর গাড়ি চালাতেন তাাদের গ্রামের জলিলের বাবা ফজর আলী। পৈতৃক সূত্রে ছয় বিঘা জমি ছিল তার। আইন বহির্ভুতভাবে নিজের ও সৌদিতে কর্মরত দুলা ভাই শফিকুলের টাকা সুদে খাটিয়ে এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক জলিল। সুদে টাকা নিয়ে চেক দেওয়ার পরও সুদাসলের পরিশোধের যন্ত্রণায় ২০১২ সালে দেশ ছাড়া শম্ভু বিশ্বাসের জমি ২০১৪ সালে জাল দলিল করে নিয়েছে সুদখোর জলিল।

একইভাবে গোবিন্দ বিশ্বাস চড়া সুদে দেড় লাখ ও রাম প্রসাদ বিশ্বাস এক লাখ টাকা নিয়ে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে রয়েছে জলিলের। তাদের বাড়িঘর লিখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে জলিল। শুধু সংখ্যালঘু নয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনেকেই সুদে জলিলের কাছ থেকে টাকা জর্জরিত হয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে।

১৯৭৮ সালে স্থানীয় অঘোর প্রমাণিকের ঘরবাড়ি, পুজার বেদী ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দেশছাড়া করার অভিযোগ রয়েছে জলিল ও তার স্বজনদের বিরুদ্ধে। অবিলম্বে সুদখোর জলিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এলাকার কয়েকটি হিন্দু পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

জানতে চাইলে জলিল মোড়ল বলেন, ছিদাম ও তার পরিবারের সদস্যরা ঋণ নিয়ে প্রতারণা করেছে অনেকের সঙ্গে। তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে চেক দিয়েছে। সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য টাকা নিয়ে বায়নাপত্র করে দিয়ে চিত্ত ও তার স্ত্রী বাসন্তী ওই জমি ছেলের নামে লিখে দিয়ে তাকে প্রতারনা করেছে। হুমকি ধামকির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তারা আদালতের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

কালীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক গোবিন্দ আকর্ষণ বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কাছে দেওয়া ছিদাম বিশ্বাসের অভিযোগটি তিনি গত ৪ জানুয়ারি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন। প্রথমিক তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে।

(আরকে/এসপি/ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

০১ নভেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test