E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Walton New
Mobile Version

স্বাধীনতা সংগ্রামে সাতক্ষীরার দলিত জনগোষ্ঠীর ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন নেই

২০২০ ডিসেম্বর ২২ ১৭:৫২:২৬
স্বাধীনতা সংগ্রামে সাতক্ষীরার দলিত জনগোষ্ঠীর ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন নেই

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাতক্ষীরার দলিত জনগোষ্ঠীর ভূমিকার যখাযথ মূল্যায়ন নেই। অনেকেই ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছেন পাক হানাদার, দেশীয় রাজাকার ও আল বদরদের বিরুদ্ধে। আবার অনেকেই নিজের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন। এরপরও তাদের মুক্তিযুদ্ধের তালিকায় নাম ওঠেনি। বুকের মধ্যে যন্ত্রণা জিয়িয়ে রেখেই সীমাবদ্ধ থেকেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাতক্ষীরার দলিত সম্প্রদায়ের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ কিম্বা বীরঙ্গনার তালিকাতেও স্থান হয়নি ওইসব দলিত মানুষের। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে এইসব মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী লগ্নেও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তণ খুব কমই ঘটেছে।

সাতক্ষীরা শহরের উত্তর কাটিয়ার (আমতলা) রাজেন্দ্রনাথ দাসের ছেলে অরুণ দাস। কোন রকমে হাতে খড়ি দিয়েই তার শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যায়। বিয়ে করেন সাতক্ষীরা শহরের রাজারবাগান কলেজের পাশে। চার ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রীকে রেখে ২০১৫ সালের ১৫ মার্চ ৭০ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান অরুন দাস।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে যেয়ে রোববার সকালে নিজ বাড়িতে বসে রাধা রানী দাস বলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েকদিন পরই স্বামী অরুন দাসের সঙ্গে তিনিও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট মহকুমার উত্তর ২৪ পরগনা জেলার হাসনাবাদে চলে যান। সেখানে তাকে রেখে স্বামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য তকিপুর ক্যাম্পে নাম লেখান। সেখান থেকে স্বামী বিহারের চাকুলিয়ায় যেয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর তিনি ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা শুনতে পান যে অরুন মারা গেছে।

তবে দু’ মাস পর বসিরহাটের ইটিণ্ডায় তাকে একজন দেখে তাদেরকে খবর দেয়। সেখান থেকে অরুন চলে আসে বাংলাদেশে। কলারোয়া সীমান্তের কাকডাঙা, সাতক্ষীরা সদরের বালিয়াডাঙাসহ বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয় অরুন। সাতক্ষীরা পাওয়ার হাউজ বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে মুক্তিযোদ্ধা সোনা ভাইয়ের সঙ্গে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল অরুন।

রাধা রানী দাস আরো বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তার ভাসুর, দেবরসহ অন্যদের সঙ্গে সাতক্ষীরায় ফিরে আসেন। এসে দেখেন তাদের বাড়ি ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির কিছুটা জায়গা দখল করে দোকান নির্মাণ করেছিল আকবর ও আলতাফের বাবা সেকেন্দার আলী। স্বামীর পৈতৃক ১৯ বিঘা জমি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট তৈরির জন্য সরকারিভাবে অধিগ্রহণ করা হয়। স্বামী কোন টাকা না নিলেও কাগজপত্র যাঁচাই করে জানতে পারেন যে কে বা কাহারা ওই জমির বাবদ সরকারের কাছ থেকে ৫০০ টাকা তুলে নিয়েছেন। ভিটা বাড়ির দেড় শতক জমি বিক্রি করলে আরো দেড় শতক জমি জোরপূর্বক দখলে নিয়েছেন স্থানীয় এক মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ।

নীচু জাতের মানুষ বলে ছেলে ও মেয়েরা বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেনি। তাই সরকাইরভাবে কোন চাকুরি পায়নি। বর্তমানে তিনি মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর সৌজন্যে মাসিক ১২ হাজার টাকা ভাতা পেয়ে থাকেন। কোন রকমে পাঁচ ইঞ্চি গাথুনির উপর টিনের চাল দিয়ে তাদের বাসবাস। এরপরও রাস্তার ধারের জায়গা বলে অনেকেরই প্রতিনিয়ত নিঃশ্বাস পড়ছে ওই জমির উপর। দলিত শ্রেণীর মানুষ হওয়ায় ছেলেদের সন্তানরাও স্কুল পাঠশালায় নানাভাবে অপদস্ত হয়। ফলে তাদের শিক্ষাঙ্গনে টিকে থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়েছে। তার স্বামীর সহযোদ্ধা শহরের পলাশপোলের কাছেদ আলীও গত বছর মারা গেছে। এ ছাড়াও যারা তার স্বামীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে তাদের কেউ আর বেঁচে নেই বললে চলে।

তালা উপজেলার হরিহর নগরের পদ ঋষি দাসের ছেলে শম্ভু দাস বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলা সনের ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক তাদের কাছে বড় দুঃসময় গেছে। ভারত থেকে প্রশিক্ষন নিয়ে ফেরা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সুজাত মাষ্টার, আবু জাফর, আবুল খায়ের ও বাগেরহাটের রামপালের বাচ্চু মিঞাসহ কয়েকজন তাকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা করেছিল। তাদের মাধ্যমে তিনিসহ একই গ্রামের জয়হরি দাসের ছেলে ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই মৃত্যুবরণকারি সুধীর দাস, একই বছরে মৃত্যুবরণকারি একই গ্রামের মান্দার দাসের ছেলে মান্দার দাস, যোগীনাথ দাসের ছেলে নিতাই দাস, বাংলা ১৪০৬ সালে মৃত্যুবরণকারি যোগী চন্দ্র ঋষীর ছেলে গণেশ দাস, মুড়োগাছার নটোবর দাসের ছেলে ১৯৯০ সালে মৃত্যুবরণকারি ভবেন দাস ও একই গ্রামের ভদ্রকান্ত দাসের ছেলে জিতেন্দ্র নাথ দাস ও হরিহর নগরের খাদালে দাসের ছেলে কানু দাসসহ কয়েকজন ওই সব মুক্তিযোদ্ধাদের আহবানে সাড়া দিয়ে তাদের গোপন আস্তানায় যাতায়াতি করতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর মুড়োগাছা থেকে নৌকাযোগে তাদেরকে বাথুয়ারডাঙাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন। রাতভর বিভিন্ন মুক্তি ক্যাম্পে অবস্থান করতেন তারা।

একপর্যায়ে প্রতিদিন ভোর না হতেই আবারো ওইসব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তারা নৌকাযোগে এলাকায় ফিরতেন। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামি মানুষের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের গুরুত্বসহকারে দেখতে হতো। এভাবে তারা তিনটি মাস কাটালেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদেরকে কেউ মনে রাখেনি। অনেক রাজাকার টাকা দিয়ে যাচাই - বাছাই তালিকায় নিজেদের নাম ঢুকিয়ে সরকারি সকল সুবিধা ভোগ করছে। অথচ গত বছর তারা সহযোগি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর আবেদন করলেও কোন সাড়া মেলেনি।

সম্প্রতি আবারো শুরু হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা যাঁচাই বাছাই এর কাজ। গতবার কোন সাড়া না পাওয়ায় তাার আর কোন আবেদন করেননি। আবেদন করেও কোন লাভ হবে বলে মনে করেন না তারা। তাদের ধর্মের উচ্চ বর্ণের অনেক রাজনৈতিক নেতা উপজেলায় থাকলেও নীচু জাতি হিসেবে তাদের উন্নয়ন তারাও প্রত্যাশা করেন না। তছাড়া এখন ভোটে জিততে ভোটার লাগে না। আগে অন্ততঃ জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য পাঁচ বছর পরপর অনেকেই তাদের বাড়িতে পদধুলি দিতেন। এখন নাকি ভোটের আগেই বাক্স ভরে যাওয়ায় তাদের কাছে আসা লাগে না। তাই সরকরি ও বেসরকারি সূযোগ সুবিধাও তারা পান না বললেই চলে।

একই এলাকার জিতেন্দ্র নাথ দাস বলেন, হয়ত তারা যুদ্ধ করতে যান নি। আবার নেননি প্রশিক্ষণও। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচাতে যেভাবে তাদের ছাদ হয়ে ছিলেন তাকে অনেকেই কোন ভাল কাজ বলে মনে করেন না। নীচু জাতিরা কোন ভাল কাজ করতে পারে এমনটি কেউ মানতে চায় না। ফলে তাদের যে দূঃখ সেই দূঃখই রয়ে গেছে। স্ত্রী, সন্তান ও স্বজনদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তণ ঘটেনি।

মুক্তিযোদ্ধা,গোবিন্দ কর্মকার বলেন,ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদী ইতিহাস বিভিন্ন নিম্ন শ্রেণীর মানুষকে স্থান দিতে যেভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদী ইতিহাস নির্মাণও একইভাবে উপক্ষো করেছে নিম্নবর্ণের মানুষের অবদান ও অংশগ্রহণ। উভয় ইতিহাসেই প্রবল শ্রেণীর প্রাধান্য লক্ষ্যনীয়। ব্রিটিশ বিরোধী প্রেক্ষাপটে যে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছিল সেই জাতীয়তাবাদের পরিসর নির্মিত ইতিহাস নিম্নবর্ণের মানুষের ঐতিহাসিক ও স্থানিক অবদানকে অস্বীকার করেছে। সব সময় তাদের অবস্থা ছিল নিকৃষ্ট অন্যের ভূমিকায়।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই জাতীয়তা ধারাটিই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে রচনার মূল ধারায় পরিণত হয়েছে। একক ও আধিপত্যশীল জাতীয়তাবাদি চিন্তা চেতনায় অভ্যস্ত এই গোষ্ঠী রচনায় তাই প্রধান প্রধান জাতীয়দাবাদী দলগুলোর অবদান ও ভূমিকার সমান্তরালে ক্রিয়াশীল সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা অনুচ্চারিত থেকেছে। ইতিহাসে স্থান পেয়েছে সামরিক ও বেসামরিক আমলা, উচ্চ শ্রেণির পেশাজীবী, রাজনৈতিক এলিট ও বুদ্ধিজীবী এর বাইরে কারো অবস্থান ইতিহাস স্বীকার করতে নারাজ। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পরও এই ইতিহাস নির্মাণের সংস্কৃতি অব্যহত রয়েছে এবং ইতিহাস নির্মাণের অচিহ্নিতায়ন জারি রয়েছে।

এ ব্যাপারে তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাঁচাই বাছাই কমিটির অন্যতম সদস্য সাতক্ষীরা সিটি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ সরকার বলেন, হরিহরনগর ও মুড়োগাছা এলাকার দলি ত জনগোষ্ঠীর অনেকেই সহায়ক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দিন রাত কাজ করেছেন। সরকারের উচিত তাদেরকে সহযোগী বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের জীবনধারার মান উন্নয়নে সহায়তা করা।

(আরকে/এসপি/ডিসেম্বর ২২, ২০২০)

পাঠকের মতামত:

১৫ জুন ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test