E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

রতনকান্দি দিবস কাল

২০২১ ডিসেম্বর ০৮ ১৭:৪০:২৩
রতনকান্দি দিবস কাল

দেবেশ সান্যাল, উল্লাপাড়া :  আগামীকাল ৯ ডিসেম্বর। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নাধীন রতনকান্দি একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এই গ্রামের মানুষের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এই গ্রামের মানুষ ছিল রাজনৈতিক সচেতন ও অসাম্প্রদায়িক। যাতায়াতের রাস্তা না থাকায় করতোয়া নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত হওয়ায় মহান মুক্তিযুদ্ধে গ্রামটি শাহজাদপুর থানার পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের ঘাটিতে পরিণত হয়েছিল। এই গ্রামের একজন মানুষও স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীতে যোগ দেয় নাই।

এই গ্রামের হিন্দু অধিবাসীদের যাতে কোন প্রকার ক্ষতি না হয় সে জন্য ডাঃ জয়নাল আবেদীন, ডাঃ খলিলুর রহমান, মোঃ আব্দুল সরকার, মোঃ আকবর প্রামানিক ও অন্যান্য দের নির্দেশে মুসলমান যুবকেরা রাত জেগে হিন্দুদের বাড়ি পাহাড়া দিতেন। হিন্দুদের মূল্যমান স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা ও অন্যান্য জিনিস পত্র সব মুসলমান প্রতিবেশীর বাড়িতে রাখা হয়েছিল। ঝুকিপূর্ণ দিন সমূহে মুসলমানগণ হিন্দুদেরকে তাদেও বাড়িতে গোপন করে রাখতেন।রাতের বেলায় শোবার ঘরে হিন্দুদের শোবার জায়গা করে নিজেরা বাহিরে ঘুমাতেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে হিন্দুরা যে সকল মূল্যমান দ্রব্যাদি মুসলমানদের দায়িত্বে রেখে ছিলেন দেশ স্বাধীন হবার পর অক্ষত অবস্থায় মুসলমানগণ হিন্দুদেরকে ফেরত দিয়েছিলেন। এই গ্রাম থেকে উত্তর বঙ্গের প্রবেশদ্বার ডাব বাগানে (বর্তমানে শহীদ নগর) অবস্থানকারী প্রতিরোধ যোদ্ধা/স্বাধীনতা কামীদের জন্য শুকনো খাবার তৈরি করে পাঠানো হতো। এই গ্রামের প্রিন্সিপাল নুরুল ইসলাম সরকারের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন অধ্যক্ষ তাহাজ্জত হোসেন, ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজার ও শাহজাদপুর থানার বিভিন্ন সরকারী/বেসরকারী পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ।

এই গ্রামের প্রিন্সিপাল নুরুল ইসলাম সরকারের ভগ্নিপতি অবসর প্রাপ্ত দারোগা মোঃ মতিউর রহমান রতনকান্দি হাটখোলায় ডামি রাইফেল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং শুরু করেছিলেন। তদানীন্তন এম. পি. এ অধ্যক্ষ এ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান আশ্রয় নিয়েছিলেন তার ভগ্নিপতি রতনকান্দি উত্তর পাড়া মোঃ নজরল ইসলাম সরকারের বাড়িতে। এই গ্রামে অবস্থান করেই মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা কে সঙ্গে নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। এই গ্রামের মোঃ রেজাউল করিম হেলাল, এস.এম. ফজলুল করিম দুলাল, মোঃ আব্দুস ছাত্তার প্রামানিক, মোঃ সামসুল হক ও শ্রী দেবেশ চন্দ্র সান্যাল ছিল ভারতীয় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। শ্রী দেবেশ চন্দ্র সান্যাল রতনকান্দি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষন নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ৭১’র ১লা সেপ্টেম্বর জামায়াত নেতা ব্যারিষ্টার কোরবান আলীর নির্দেশে পুঠিয়া গ্রামের খ্যাত নামা শিক্ষক হিতেন্দ্র নাথ চন্দকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। শাহজাদপুর রাজাকার ক্যাম্প থেকে রতনকান্দি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের তদানীন্তন প্রধান শিক্ষক শ্রী দেবেন্দ্র নাথ সান্যালের কাছে চিঠি পাঠায়। চিঠিতে লেখা ছিল” আপনার ভাই দেবেশ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, আগামী ৭ দিনের মধ্যে তাকে ফিরিয়ে না আনলে আপনাদের পরিবারের সবাইকে লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হবে আর বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হবে”। চিঠি পেয়ে দেবেশের পরিবারের সবাই আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তায় বাড়ি ঘর সব কিছু গ্রামের হোসেন আলীর কাছে বিক্রি করে মাতৃভূমি ছেড়ে ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করে।

রতনকান্দি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র দেবেশ চন্দ্র সান্যাল মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বিভিন্ন সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে বিশেষ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তার তীক্ষè বুদ্ধি আর বীরত্বের কারণে তিনি ৭নং সেক্টরের যোদ্ধাদের কাছে জীবন্ত কিংবন্তি হিসেবে গণ্য হয়ে ছিলেন। শাহজাদপুর থানার সর্বত্র তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর বাহিনী কে সবাই বিচ্ছু বাহিনী বলে সম্বোধন করতো। মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন পাক হানাদার বাহিনীর দোসর শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকার, আলবদর ও আলশামসরা তার বাহিনীর নাম শুনে আঁতকে উঠতো। তাঁর বাহিনী সর্বশেষ যুদ্ধ করে শাহজাদপুর থানার ধীতপুর নামক স্থানে। শাহজাদপুর থানার ধীতপুর যুদ্ধে জয়ী হয়ে দেবেশ চন্দ্র সান্যাল ৯ ডিসেম্বর ৭১ বৃহস্পতিবার ভোরে রণাঙ্গনের সাথীদের নিয়ে চলে আসেন রতনকান্দি গ্রামে। তিনি থ্রি নট থ্রি রাইফেল থেকে আকাশ মুখী গুলি ছোড়েন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু রণধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলেন রতনকান্দি গ্রাম। গ্রামে বিজয় উল্লাস শুরু হয়। তাঁকে এক নজর দেখার জন্য স্কুল সাথীরা সহ গ্রামের অনেক নারী পুরুষ সমবেত হয়। তিনি তার রণাঙ্গনের সাথী ও অন্যান্যদের নিয়ে চলে আসেন রতনকান্দি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। তিনি নিজে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে, জাতীয় সংগীত গেয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল ও অন্যান্য শিক্ষকদের সম্মুখে জাতীয় সংগীত গেয়ে ছিলেন। সে দিনও বাঘাবাড়ী ঘাট পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর ও শামসদের দখলে ছিল। কৈজুরী, পোরজনা ও কর শালিকায় রাজাকার ক্যাম্প চালু ছিল। ৯ডিসেম্বর ভোর থেকে বাঘাবাড়ী ঘাট ও আশপাশের রাজাকার ক্যাম্প থেকে রাজাকরেরা অস্ত্র নিয়ে এসে রতনকান্দি গ্রামে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অত্মসমর্পন করতে শুরু করলো।১৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় শাহজাদপুর। মহান মুক্তিযুদ্ধে রতনকান্দি গ্রামের মানুষের অবদানের কথা স্মরণে রাখতে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর এই গ্রামের মানুষেরা উদযাপন করে থাকেন “রতনকান্দি দিবস”।

(ডিএস/এসপি/ডিসেম্বর ০৮, ২০২১)

পাঠকের মতামত:

১০ মে ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test