E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও রাজেন্দ্র কলেজের প্রভাষক আনসার আলী গ্রেফতার

২০২৫ মে ০৩ ০০:৫২:৪৪
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও রাজেন্দ্র কলেজের প্রভাষক আনসার আলী গ্রেফতার

তন্ময় উদ্দৌলা, ফরিদপুর : রাজনীতির জৌলুস, শিক্ষকতার মর্যাদা আর ধর্মীয় আবেগ—এই তিন অস্ত্র দিয়েই এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের বুনিয়াদে আঘাত করে গেছেন সৈয়দ আনসার আলী। আলোচিত এই সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও রাজেন্দ্র কলেজের সাবেক প্রভাষক অবশেষে আইনের জালে ধরা পড়েছেন।

ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানায় প্রতারণা মামলায় এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি আনসার আলীকে র‍্যাব-১০ এর সহায়তায় গ্রেফতার করেছে আলফাডাঙ্গা থানা পুলিশ।

বৃহস্পতিবার (১ মে) বিকেলে তাকে আদালতে প্রেরণ করা হয়। এর আগে, ৩০ এপ্রিল ভোররাতে রাজধানীর লালবাগে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করা হয়। অভিযানে নেতৃত্ব দেন আলফাডাঙ্গা থানার এসআই (নিরস্ত্র) সুজন বিশ্বাস।

গ্রেপ্তারকৃত সৈয়দ আনসার আলী ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার বাজড়া গ্রামের বাসিন্দা। তার পিতা সৈয়দ আতর আলী। আনসার রাজেন্দ্র কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের প্রভাষক। বোয়ালমারী থানার সিআর মামলা নম্বর ৯২/২১-এর অধীনে ৪২০/৪০৬ ধারায় সাজাপ্রাপ্ত এই আসামি দীর্ঘদিন পলাতক ছিলেন।

বড় বড় আশ্বাস, কোটি টাকার হাতবদল
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আনসার আলী নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ নেতা পরিচয় দিয়ে সরকারি চাকরি, বিদেশে পাঠানোসহ নানা আশ্বাসে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৪৫ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন। কেউ চাকরির প্রত্যাশায়, কেউবা বিদেশযাত্রার আশায় তার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। তার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও আছে ৭২ লাখ টাকার প্রতারণা মামলা।

ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে তিনি নিজেকে
“রিপন-রোটন কমিটি’র” কেন্দ্রীয় সদস্য দাবি করতেন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যে, চাকরির পাশাপাশি বিসিএস প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গেও যুক্ত হন বলে জানিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।

কলেজে ছিলেন অনুপস্থিত, বেতন নিয়েছেন নিয়মিত
রাজেন্দ্র কলেজের সমাজকর্ম বিভাগে ২০১৩ সালে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন আনসার আলী। প্রথম ছয় মাস ছিলেন কর্মস্থলে। এরপর থেকে নিয়মিত অনুপস্থিত থাকলেও ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত তুলে গেছেন সরকারি বেতন। বারবার শোকজ, স্থগিতাদেশ—সবই অকার্যকর করে তুলতেন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়।

২০২৪ সালের আগস্টে অধ্যাপক রমা সাহা তার বেতন স্থগিত করেন। বর্তমান অধ্যক্ষ অধ্যাপক এস. এম আবদুল হালিম সেই আদেশ বহাল রাখেন।

অধ্যক্ষ বলেন, “রাজেন্দ্র কলেজের মত ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক এমন কেলেঙ্কারিতে জড়াবে—এটা লজ্জাজনক। অনুপস্থিতির কারণে বারবার শোকজ করা হলেও তিনি কর্ণপাত করেননি। প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন টিকে ছিলেন। বর্তমান সরকার আসার পরই তার বেতন বন্ধ হয়।”

ধর্মীয় আবেগকে ঢাল বানিয়ে প্রতারণা
শুধু রাজনীতি বা শিক্ষকতা নয়, ধর্মীয় আবেগকেও বাণিজ্যে রূপ দিয়েছিলেন আনসার আলী। নিজের গ্রামের মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে আনতেন দেশবরেণ্য বক্তা— মিজানুর রহমান আজহারী, আমির হামজা, আব্দুল্লাহ আল-আমিন প্রমুখ।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মোতালেব মাতুব্বর বলেন, “আনসার আলী মাঝেমধ্যে গ্রামে এসে বড় বড় হুজুর এনে ওয়াজ মাহফিল করাতো, যুবকদের নিয়ে এলাকার উন্নয়নের কাজ করত । ২০১৯ সালে তিনদিনের বিশাল মাহফিল হয়েছিলো আমাদের মাদ্রাসা মাঠে—আজহারী সাহেবও এসেছিলেন। লোকজনের মাঝে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে।”

এই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে আনসার আলী প্রতারণার জাল বিস্তার করেন। কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা এবং তৎকালীন আওয়ামিলীগ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি করে চাকরির প্রলোভনে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা এবং মূল সনদপত্র আদায় করতেন তিনি।

ভুক্তভোগী আলিমুজ্জামান বলেন, “২০১৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আনসার আলী আমার কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেয় এবং আমার সব মূল সার্টিফিকেট জমা রাখে। এরপর আর কোনো যোগাযোগ নেই। সার্টিফিকেট না থাকায় অন্য কোথাও আবেদনও করতে পারিনি।”

আরেক ভুক্তভোগী হারান সাহা বলেন, “আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে আনসার আলী। চার বছর ধরে আমার ১০ লক্ষ টাকা আর সব সার্টিফিকেট আটকে রেখেছে। মামলা করেছি, এখন রায়ের অপেক্ষায়। চাকরির বয়স শেষ—এখন কী করবো?”

আলফাডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি আরিফুজ্জামান চাকলাদার জানান, আনসার আলী প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগের গল্প শুনিয়ে বহু মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। ফরিদপুরের তৎকালীন ডিসির সাথেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে এলাকায় প্রচার চালাতেন।

“দুর্ধর্ষ প্রতারক” — পুলিশ বলছে যা আলফাডাঙ্গা থানার ওসি হারুন অর রশিদ বলেন, “আনসার একজন উচ্চশিক্ষিত, কৌশলী ও দুর্ধর্ষ প্রতারক। বোয়ালমারী থানার মামলায় তার বিরুদ্ধে আদালতের রায় ছিল। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে ” তিনি আরও বলেন, “তার সঙ্গে জড়িত অন্যদের শনাক্তে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।”

(টিইউ/এএস/মে ০৩, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test