E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

অভয়নগরে তরিকুল হত্যা ও ১৮টি হিন্দু বাড়িতে লুটপাট অগ্নিসংযোগ

হত্যা মামলায় ৪ জন ও অগ্নিসংযোগ মামলায় ৪ জন গ্রেপ্তার, রিমাণ্ড আবেদন, পুরুষশূন্য এলাকা 

২০২৫ মে ৩১ ১৭:২১:৪২
হত্যা মামলায় ৪ জন ও অগ্নিসংযোগ মামলায় ৪ জন গ্রেপ্তার, রিমাণ্ড আবেদন, পুরুষশূন্য এলাকা 

রঘুনাথ খাঁ, অভয়নগর থেকে ফিরে : গত ২২ মে যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের ডহর মশিয়াহাটির গ্রামের বাড়েদাপাড়ায় কৃষকদল নেতা তরিকুল হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সনাতন ধর্মালম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের ১৮টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, মারপিট ও অগ্নিসংযোগ এবং সুন্দলী বাজারের ১৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ওলুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলায় চারজন এবং লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এ পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রত্যেককে সাত দিন করে রিমাণ্ড আবেদন করা হয়েছে। আগামি সোমবার যশোর আদালতে তাদের রিমাণ্ড শুনানির জন্য দিন ধার্য আছে।

হত্যা মামলার আসামিরা হলেন- অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটির গ্রামের বাড়েদাপাড়ার সুজিত বিশ্বাসের ছেলে সাগর বিশ্বাস, একই গ্রামের দিল্লিশ্বর বিশ্বাসের ছেলে সুন্দলী বাজারের গৃহ নির্মাণ সামগ্রী বিক্রেতা দীনেশ বিশ্বাস, ডহর ময়িারহাটি গ্রামের অরবিন্দ মণ্ডলের ছেলে ডহর মশিয়ারহাটি সরকারি প্রাথািমক বিদ্যালয়ের পাশে মুদি ব্যবসায়ী অনিমেষ মণ্ডল ও যশোরের রামনগর গ্রামের ফিরোজ খান। এ ছাড়া লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মামলায় গ্রেপ্তারকৃতরা ধৌপদীসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা।

অরবিন্দ মণ্ডল জানান, ২২ মে রাতে তার ছেলে অনিমেষ মণ্ডল একজন মুদি ব্যবসায়ি। বাড়েদাপাড়ার লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। এজাহারে তার নাম ছিল না। অথচ শুক্রবার সন্ধ্যায় দোকানে অবস্থানকরাকালিন পুলিশ অনিমেষকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে তরিকুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমাণ্ড চাওয়া হবে বলে তিনি শুনেছেন।

এদিকে তরিকুল হত্যা মামলায় ১১জন আসামীর মধ্যে সাতজনই ডহর মশিয়াহাটির গ্রামের মতুয়া সম্প্রদায়ের বাসিন্দা হওয়ায় ও অজ্ঞাতনামা ২৫ জনকে আসামী করায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে এলাকা পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে।

ডহর মশিয়াহাটির গ্রামের বাড়েদাপাড়ার সুজিত বিশ্বাস জানান, তিনি একজন দিন মজুর। ২৩ মে তার বাড়িতে হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুষ্ঠান ছিল। সে কারণে ২২ মে তিনি সুন্দলী বাজারে কেনা কাটার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ২২ মে সন্ধ্যার আগেই পিল্টুর বাড়িতে তরিকুল খুন হয়েছেন এমন খবর পেয়ে এক হাজার ৭০০ টাকার কলা তিনি মাত্র ৭০০ টাকায় বিক্রি করে দিলেও হামলাকারিদের ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারেননি। পরে তিনি খবর পান বড় বউদি স্মৃতিদ রানী বিশ্বাসকে লাখি মেরে সাগরকে ও্ বাড়ি থেকে মারতে মারতে তুলে নিয়ে যায় হামলাকারিরা। পরে তাকে পুলিশে দেওয়া হয়। ২৪ মে তারিখে তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২৬ মে তাকে তরিকুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এমনকি তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাত দিনের রিমা- আবেদন জানানো হয়েছে।

একইভাবে একইগ্রামের দিল্লীশ্বর বিশ্বাস জানান, তার ছেলে দীনেশ বিশ্বাসের সুন্দলী বাজারে গৃহ নির্মাণ সামগ্রী বিক্রেতার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ২২ মে রাতে ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে তারা জানতে পারেন যে, নিহত তরিকুলের ভাই রফিকুল ইসলাম টুলু ২৬ মে যে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন তাতে বিনা টাকায় জমি লীজ দিতে রাজী না হওয়া ব্যক্তিদের ও তাদের প্রতিপক্ষ মুসলিম সম্প্রদায়ের চারজনকে আসামী করা হয়েছে। তার ছেলে দীনেশ বিশ্বাসকে আসামী করায় সে প্রাণ ভয়ে গত মঙ্গলবার ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার সময় বিজিবি আটক করে অভয়নগর থানায় পাঠায়। বুধবার তাকে তরিকুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলখানায় পাঠানো হয়। বৃহস্পতিবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন জাননো হয়েছে। তরিকুল ইসলাম জিবলু হত্যা মামলাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ক্ষতিগ্রস্ত মতুয়া সম্প্রদায়ের সদস্যদের নামে ও তরিকুলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সরেজমিনে শুক্রবার সকালে বাড়েদাপাড়ায় যেয়ে দেখা গেছে, এলাকা পুরুষ শুন্য। এমনকি বাড়িতে নেই কোন অল্প বয়সী নারী ও পুরুষ। সরকরিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পিছু ছয় বান করে টিন ও নগদ ছয় হাজার টাকা করে দেওয়া হলেও তা যথেষ্ট না হওয়ায় ঘরবাড়ি সংস্কারে কেউ উদ্যোগ নিতে পারেননি। তবে দুই থেকে তিনটি পরিবার পোড়া জিনিসপত্র সরিয়ে মেঝেতে কোন রকমে পলিথিন বিছিয়ে বসে রয়েছেন। রাতে তারা অন্যত্র অবস্থান করেন। প্রথম দিকে যেভাবে পুলিশের তৎপরতা ছিল এখন অনেক কমে গেছে। সুন্দলী ইউনিয়নের পাঁচকাটিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ শুভেন্দু বিশ্বাসের নেতৃত্বে ঢাকা হাইকোর্টের ২৫ জন আইনজীবী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছেন। হিন্দু মহাজোটের বিধান গোস্বামীর নেতৃত্বে একটি টিম ছাড়াও সাতক্ষীরা থেকে অ্যাড. খগেন্দ্রনাথ ঘোষের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছেন। হত্যা মামলাটির তদন্তভার অভয়নগর থানার উপপরিদর্শক আশিকুর রহমানের কাছ থেকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশে স্থানান্তর করা হয়েছে। লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মামলাটির তদন্তভার উপপরিদর্শক মোঃ সালাহউদ্দিনের কাছ থেকে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক স্থানীয় কয়েকজন জানান, হিন্দুদের জমি বিনা টাকায় লীজ নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন তরিকুল। আর এ হত্যাকাণ্ডকে পুুঁজি করে একটি মহল হিন্দু বিতড়নের অংশ হিসেবে এ হামলা, মারপিট, ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে পেট্রোল দিয়ে ঘরে ঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে। অথচ সেই ক্ষদিগ্রস্তদের নামে মামলা দেওয়া হয়েছে। ২০/২৫ জন অজ্ঞাতনামা আসামী করায় পাড়ার পুরুষ সদস্য ছাড়াও অনেক নারী সদস্য বাড়ি ছাড়া। জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমাণ্ডে নিয়ে নিরীহ সাগর ও দীনেশের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

এ ছাড়া রাতে বাড়িতে থাকার মত অবস্থা তৈরি না হওয়া ও বই খাতা পুড়ে যাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। ঘটনাস্থলে আসা অনেকেই চিড়া, গুড়সহ শুকনা খাবার দিলেও প্রয়োজনীয় পোশাকের অভাবে অনেকে বাইরে বের হতে পারছেন না। শুক্রবার সন্ধ্যায় মুদি ব্যবসায়ি অনিমেষ মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি এজাহারভুক্ত আসামী নন। তারা ধারণা করছেন তরিকুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার বাণিজ্য শুরু হয়ে গেছে। বাড়েদাপাড়াসহ আশেপাশের মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ আর বাড়ি ফিরতে পারবে না। তাদের ঘরবাড়ি সংস্কারও করা সম্ভব হবে না।

যশোর জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. সুমন কুমার দে জানান, তিনি সাগর বিশ্বাসের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাবেন তিনি।

নওয়াপাড়া পৌর কৃষকদলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম জিবলু হত্যা মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা যশোর গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঞ্জুরুল কবীর ভুঁইয়া জানান, এ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া সাগর বিশ্বাস, দীনেশ বিশ্বাস ও ফিরোজ খান নামের তিন এজাহারভুক্ত ও এক সন্ধিগ্ধ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন জানানো হয়। তাদেরকে রিমাণ্ড শুনানীর জন্য আগামি সোমবার দিন ধার্য করা হয়েছে। শুক্রবার গ্রেপ্তার করা অনিমেষ মণ্ডলকে শনিবার আদালতে সাত দিনের রিমা- আবেদন জানানো হবে।

অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সুশান্ত বিশ্বাসের স্ত্রী কল্পনা বিশ্বাসের দায়েরকৃত ঘরবাড়ি পোড়ানো ও লুটপাটের মামলায় শুক্রবার পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রত্যেককে সাত দিন করে আদালতে রিমাণ্ডের আবেদন জানানো হয়েছে। আগামি ২ জুন রিমাণ্ড শুনা হবে। এলাকার পরিস্থিতি ক্রমশঃ শান্ত হচ্ছে। সুন্দলী বাজার ও বাদেড়াপাড়ায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

(আরকে/এসপি/মে ৩১, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

৩১ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test