E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

প্রস্তুত কোরবানির পশু, ভালো দাম পেতে আশাবাদী নীলফামারীর খামারিরা

২০২৫ জুন ০২ ১৯:৩৫:১৬
প্রস্তুত কোরবানির পশু, ভালো দাম পেতে আশাবাদী নীলফামারীর খামারিরা

ওয়াজেদুর রহমান কনক, নীলফামারী : চারপাশে বৃষ্টি আর কাদা মাখা মেঠোপথ। সকাল থেকে অঝোর বৃষ্টি আর থেমে থেমে গুঁড়িগুঁড়ি ঝরার মাঝে খামার থেকে গরু নিয়ে হাটের দিকে রওনা দিয়েছেন গৃহস্থরা। গরুর গায়ে কাদা ছিটে পড়লেও তাদের থামানোর উপায় নেই—গরুর শিংয়ে, গলায় বাঁধা দড়ির ঝোলানো ঘণ্টির মতো বাজতে থাকে পায়ের ছন্দের শব্দ। রাস্তার ধারে ঝোপঝাড় ভিজে টসটস করছে, কোথাও আবার নালার জল উপচে পড়ছে।

কেউ বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে গরুর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কেউ বা নিজের কাঁধে চাদর টেনে বৃষ্টির ধারা ঠেকানোর চেষ্টা করছে। কাদা পিচ্ছিল রাস্তায় গরু যেন পা ফসকে না পড়ে, তাই সঙ্গে থাকা কিশোর বা বৃদ্ধা খামারি সাবধানে পথ দেখাচ্ছে। কিছু জায়গায় হাঁটুসমান পানি জমে গেছে, তবু হাটের টান বড় বেশি।

একা নয়, গ্রামের আরও অনেকে একই সময়ে বের হয়েছে। কাদা ছাপিয়ে এগিয়ে চলেছে সবাই—মুখে হাসি, মনে উত্তেজনা। পথের ধারে শিশুরা ভিজে গায়ে কাপড় না ভেবেই দাঁড়িয়ে দেখে কার গরু কত বড়, কার রঙিন ঘণ্টি সবচেয়ে সুন্দর।

হাটে গিয়ে পৌঁছালে কাদা মাখা গরুগুলোকে আবারও ঝাড়ামোছা করা হচ্ছে। কেউ চটের ব্যাগ বা কাপড় দিয়ে গরুর গা মুছে দিচ্ছে, কেউ খাঁচায় বা দড়িতে গরু বেঁধে রাখছে। বৃষ্টির ফাঁকে ভেজা মাটির গন্ধে ভর করে আসে হাটের ডাক—কেউ দরদাম করছে, কেউ বা গরুর স্বাস্থ্য দেখে যাচাই করছে।

বর্ষার এই ভিজে সকালেও যেন গরু হাটের উচ্ছ্বাস কমে না। প্রকৃতির সান্নিধ্যে, গৃহস্থের খামার থেকে হাট পর্যন্ত এই যাত্রায় ধরা পড়ে বাংলাদেশের জীবন্ত গ্রামীণ ছবি—বৃষ্টির সুরে, কাদা মাটির গন্ধে মিশে যায় মানুষের পরিশ্রম আর জীবিকার গল্প।

পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে নীলফামারীর খামারি ও গৃহস্থরা গরু-ছাগল প্রস্তুতের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছেন। এখন ক্রেতা-বেপারীরা খামারে গিয়ে দরদাম শুরু করলেও জেলার হাটবাজারগুলোতে পশুর বেচাকেনা জমে উঠেছে।। এদিকে, স্বাস্থ্যসম্মত এবং প্রাকৃতিক উপায়ে মোটাতাজা করা পশু নিয়েই এবারের বাজারে বেচাকেনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এবছর নীলফামারীতে ৩৪ হাজার ৩৮৩টি বাণিজ্যিক ও পারিবারিক খামার রয়েছে, যেখানে গরু-ছাগল মিলিয়ে ২ লাখ ৮৯ হাজার ১৫৭টি পশু রয়েছে। জেলার চাহিদা ২ লাখ ২৩ হাজার ১৬৬টি পশু। ফলে চাহিদার চেয়ে প্রায় ৬৬ হাজার পশু বেশি থাকছে, যা পাশের জেলায় সরবরাহ করা হবে। এসব পশুর মধ্যে ষাঁড় ৫২ হাজার ১০টি, বলদ ৪ হাজার ২৩১টি, গাভী ২৫ হাজার ৭৯৮টি, মহিষ ৮৯টি, ছাগল ১ লাখ ৯১ হাজার ৯৫৭টি এবং ভেড়া ১৪ হাজার ৯৭২টি।

নীলফামারী শহরের পুরাতন গরুর হাট এলাকার রায়হান আনসারী জানান, প্রতিবছর ঈদকে সামনে রেখে তিনি কিছু গরু পালন করেন। এ বছর ২৩টি গরু পালন করেছেন। ক্রেতারা খামারে এসে দরদাম করছেন এবং কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ভালো দামে গরু বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তিনি।

জেলা শহরের আরেক খামারি গোলাম মোস্তফা কামাল জানান, দেশি পদ্ধতিতে প্রতিবার ১০-১২টি ষাঁড় লালন-পালন করেন। এবার বাজারে দেশি গরুর চাহিদা বেশি থাকায় ভালো লাভের আশা করছেন তিনি। একইভাবে, সদর উপজেলার সিংদই এলাকার আদিল এগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী আজমাইন আদিল সাকিব বলেন, শখের বশে খামার শুরু করলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে পশু পালন করছেন। গত বছর ১৫০টি দেশি ষাঁড় বিক্রি করেছেন, এবার প্রস্তুত ২০০টি ষাঁড়। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারীরা গরু বুকিং দিচ্ছেন, ভালো দাম পাওয়ার আশাও করছেন তিনি।

তবে খামারিরা জানাচ্ছেন, পশুখাদ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে পশু লালন-পালনের খরচে। খামারে প্রতিদিন প্রাকৃতিক খাদ্য—যেমন ভুট্টার খৈল, সরিষার খৈল, ব্র্যান্ড, কাঁচা ঘাস, গমের ভুসি, চালের কুঁড়া ও খড়—খাওয়ানো হচ্ছে। দিনে দুই-তিনবার গোসল করানো, পশুর থাকার জায়গা পরিষ্কার রাখা এবং সার্বক্ষণিক ফ্যান চালিয়ে ঠাণ্ডা রাখা হচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. সিরাজুল হক জানান, খামারিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে প্রাকৃতিক উপায়ে পশু মোটাতাজাকরণের জন্য। জেলার চাহিদা পূরণ করে বাইরেও সরবরাহ সম্ভব হবে। হাটে নিরাপদ বেচাকেনার জন্য প্রশাসন ও পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে। পাশাপাশি পশু অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য পশু চিকিৎসক দল নিয়োজিত থাকবে।

সৈয়দপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. এ কে এম ফরহাদ নোমান বলেন, খামারিদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে দানাদার খাদ্য ও কাঁচা ঘাস খাওয়ানোর জন্য। ভিটামিনের ব্যবহারের পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে। তবে কোনো ধরনের নিষিদ্ধ রাসায়নিক বা হরমোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে। তিনি জানান, নীলফামারীর গৃহস্থ ও খামারিরা প্রাকৃতিক খাবারেই পশু মোটাতাজা করায় এ জেলার গরু-ছাগলের চাহিদা রয়েছে সারাদেশে। এবছর ভারত থেকে গরু না এলে দেশি পশুই কোরবানির হাটের চাহিদা মেটাতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

(ওকে/এসপি/জুন ০২, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

৩১ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test