E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

ফরিদপুরে ইজ্জলের মৃত্যুর দশদিন পেরিয়ে গেলেও গ্রেফতার হয়নি কেউ

২০২৫ জুন ১৮ ০০:৩৩:৪৬
ফরিদপুরে ইজ্জলের মৃত্যুর দশদিন পেরিয়ে গেলেও গ্রেফতার হয়নি কেউ

রিয়াজুল রিয়াজ, বিশেষ প্রতিনিধি : ফরিদপুরের কানাইপুরে ইজ্জল হত্যায় জড়িতদের নাম প্রকাশ্যে আসলেও এখনো কেউ গ্রেফতার হয়নি। তদন্ত চলমান রয়েছে জানিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও কাউকে আটক করা হয়নি বলে জানিয়েছেন ওই ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও কোতয়ালি থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) সনাতন কুমার মন্ডল।

তবে, ঘটনার পর থেকে চিহৃিত অভিযুক্তদের মধ্যে ক্ষমতাধর দু'একজন বাদে বাকী সবাই ঘটনার দিন থেকেই ঘরবাড়ি ও এলাকা ছেড়ে পলাতক রয়েছেন। পুলিশ বলছে তদন্ত শেষ হলে গ্রেফতারের বিষয়ে ভাববেন তারা। হাসপাতাল থেকে বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর প্রাথমিক রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে উজ্জলের বিষয়টি পুলিশের খাতায় অপমৃত্যু মামলা (অ.মৃ. মা. নং ৫৭, তারিখ: ৭ জুন) হিসেবে রেকর্ড হয়েছে। তাছাড়া, সরকারি দীর্ঘ ছুটি থাকায় পুলিশের তদন্তেও কিছুটা ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে।

গত ৭ জুন পবিত্র ঈদুল আযহার দিনে জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে ইজ্জল শেখ (৪৫) এর ওপর মব নিপীড়ন এবং এরপর তার রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনাকে নিহতের পরিবারের দাবি- জুয়ায় হেরে একটি বাটন মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে সংঘবদ্ধ নিপীড়ন করে, নদীর পানিতে চুবিয়ে, বিষ খাইয়ে ও গলায় গামছা পেচিয়ে হত্যা করা হয়েছে ইজ্জল শেখকে। এছাড়া, ওইদিন দীর্ঘ সময় তাকে হাসপাতালে না নিয়ে ফেলে রাখারও অভিযোগ করেছিলেন নিহতের মামা মাসুদ ব্যাপারি।

যাদের বিরুদ্ধে ইজ্জলকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে, তারা প্রায়ই সবাই কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের লোকজন। অপরদিকে হত্যার শিকার ইজ্জলের পরিবার অতি হতদরিদ্র ও ওই এলাকার ভাটাটিয়া বাসিন্দা হওয়ার কারণে নিহতের মৃত্যু রহস্য সঠিকভাবে উৎঘাটন হবে কিনা, সেটা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসি ও ইজ্জলের পরিবার।

এ নিষয়ে ফরিদপুর কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদ উজ্জামান বলেছেন, ইজ্জলের মৃত্যু ঘিরে যেহেতু 'হত্যা' ও 'আত্মহত্যা'র দাবি উঠেছে, তাই এই হত্যার মূল রহস্য উদঘাটনে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে।

এদিকে, একটি প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে ইজ্জল শেখের মৃত্যু রহস্য ধামাচাপা দিতে এবং নিহতের পরিবারকে টাকা পয়সা দিয়ে ওই ঘটনার মীমাংসা করতে দেন দরবার অব্যাহত রয়েছে বলেও জানা গেছে। কুমার নদীর পাড়ে অবস্থিত কানাইপুরের হোগলাকান্দি গ্রামের ইজ্জলের মৃত্যুর ঘটনাস্থলকে স্থানীয়রা 'বাইদ্যা পাড়া' বলে ডাকেন। এই 'বাইদ্যা পাড়া'য় একটি সংঘবদ্ধ ভোট ব্যাংক রয়েছে, তাই রাজনৈতিকভাবেও এলাকাটির যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে বটে। যার ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক একটি পক্ষ চাচ্ছেন ঈদের দিনে মব নিপীড়নের পর ইজ্জলের মৃত্যুর ঘটনার রহস্যটি নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে নিখুঁতভাবে উন্মোচিত হোক, অপরপক্ষ চাচ্ছেন নিহতের হতদরিদ্র পরিবারকে একটি মোটা অংকের টাকা দিয়ে এই ঝুট ঝামেলা এখানেই শেষ করা হোক।

কানাইপুর এলাকার মাদক ও অপরাধ প্রবন এলাকা হিসেবে পরিচিত বাইদ্যা পাড়ায় ইজ্জল শেখের মৃত্যুর ঘটনায় যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে ততই যেনো কান পাতলেই স্থানীয়ের মুখে মুখে ও কুমার নদের শীতল বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ইজ্জলকে মব নিপীড়ন করা মানুষগুলোর কমপক্ষে চার-পাঁচ জনের সুস্পষ্ট নাম। যাদের মধ্যে কয়েকজন বাদে সবাই ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছেন। সেই সাথে বের হয়েছে ইজ্জলকে ওই দিন চার দফা মারধরের শেষ দফায়, তার ওপর আক্রমনের লোকের সংখ্যা ছিলো বারো থেকে পনেরো জনের মতো।

এদিকে সরকারি ছুটি থাকার কারণে পুলিশের কাজে ধীরগতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ঘটনা মিটমাটে নিহতের পরিবারের সাথে জড়িতদের পক্ষ থেকে দেন-দরবার ইত্যাদি বিষয়গুলো ইজ্জলের মৃত্যু রহস্য উন্মোচনে সময় ক্ষেপণ করছে কিনা, সেই প্রশ্নও উঠে এসেছে।

মব নিপীড়নের ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই এলাকার একজন শিক্ষিত সচেতন নাগরিক জানান, 'আসলে ইজ্জল শেখের পরিবার একেবারেই হতদরিদ্র, সেই চিন্তা থেকেই হয়তো অপরাধীরা টাকা দিয়ে এই ঘটনা মেটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তাদের দারিদ্র্যতাকেই টার্গেট করে।' তিনি আরও বলেন, 'অলরেডি নিহতের মামা বাড়ীর কয়েকজন টাকা দিয়ে ঘটনা মীমাংসা করে ফেলার পক্ষে মত দিয়েছেন। যদিও নিহতের বোনেরা কেউ তাতে রাজি হননি এখনও, তারা সবাই চাচ্ছেন ভাই হত্যার বিচার ও হত্যায় জড়িতদের ফাঁসি। তথাপিও ওই বোনদেরও রাজি করাতে একাধিক পন্থায় কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন কয়েকটি মহল। নিহতের বিধবা স্ত্রী নবিরন বেগম (৩৫) ঘটনার পরের দিন (৮ জুন) গণমাধ্যমের কাছে সরাসরি বলেছিলেন, 'আমরা কোনো টাকা পয়সা চাইনা, আমার সন্তানদের যারা এতিম করেছে তাদের ফাঁসি চাই।' অথচ সেই তিনিই মাত্র আট-নয় দিনের ব্যবধানে এখন 'শাম রাখি না কুল রাখি' অবস্থায় রয়েছেন।' এছাড়া, নবিরন-কে বুঝানোর চেষ্টা চলছে এই বলে যে, 'স্বামীকে তো আর ফেরত পাবা না; এইভাবে সারা জীবন ভিক্ষা করে কিভাবে ছেলে-মেয়ে মানুষ করবা? তার থেকে কিছু টাকা এনে দেই, কিছু একটা করে কেটে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে খাও, চলো।'

সরেজমিন হোগলাকান্দি গ্রাম ঘুরে এবং ওই এলাকার সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে এখন মনে হচ্ছে, 'খুব শীঘ্রই টাকার জাহাজে চড়ে ইজ্জল শেখের মৃত্যু রহস্য হয়তো কুমার নদের পানিতে ভেসে যেতে পারে! অতি হতদরিদ্র ও ভাড়াটিয়া শ্রেনির নিহতের পরিবারটি, স্থানীয়দের পারিপার্শ্বিক নানান চাপ ও যাপিত জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে শামাল দিতে না পেরে, শেষ পর্যন্ত টাকা-পয়সার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হতে পারেন বা মীমাংসার পথে হাটতে পারেন! এই মুহুর্তে এর ব্যতিক্রম হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হচ্ছে!

গত ঈদুল আযহার দিন (৭ জুন) থেকে সোমবার (১৬ জুন) পর্যন্ত ইজ্জলের মৃত্যুর ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানি তথ্যের খুটিনাটি অবগত করে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নিতে 'দৈনিক বাংলা ৭১' যোগাযোগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি (অপরাধ বিজ্ঞান) বিভাগের একাধিক শিক্ষকের সাথে।

তবে, অপরাধ বিজ্ঞান এবং পুলিশিং বিষয়ক তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান প্রদানে অভিজ্ঞ শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারপার্সন শাহরিয়া আফরিন এ বিষয়ে 'দৈনিক বাংলা ৭১' কে এ বিষয়ে তাঁর বিশেষজ্ঞ মতামত জ্ঞাপন করেন। এসময় শাহরিয়া আফরিন বলেন,' ইজ্জলের বিষয়ে কোনো লেনদেনের মাধ্যমে সমঝোতা নয়, রবং তাঁর মৃত্যু রহস্য উন্মোচন করে দোষীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনা উচিত।' তিনি আরো বলেন, 'টাকা পয়সা লেনদেনের মাধ্যমে যদি এমন মামলার সমাধান হয়, তবে মব নিপীড়ন ও হত্যার মত অপরাধগুলো সমাজে বাড়বে ছাড়া কমার কোনো সম্ভাবনা থাকবেনা, বরং এসব দেখে প্রটেনশিয়াল ক্রিমিনালগুলো উৎসাহিত হবে।'

দেশের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের শিকার করে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, 'অবশ্য আমাদের শিকার করে নিতে হবে যে- আমাদের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমে এখনও অনেক দুর্বলতা রয়েছে, বিশেষ করে- খুন, ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের মতো কিছু ঘটনা হয়তো আপনাদের (গণমাধ্যম কর্মীদের) কাছে আসেও না। তার আগেই এসব অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মীমাংসা করে ফেলার চেষ্টা করা হয়।'

তিনি বলেন, 'লোকলজ্জার ভয় বা আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী বা তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ঘটনার পোপনীয়তা রক্ষার জন্য শালিসি মীমাংসায় রাজি হতে দেখা যায়। এরকম অনেক ঘটনাই যে ঘটছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নাই। এবং এসব আমাদের নানাবিধ সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতার কারণেই হচ্ছে।

এছাড়া, মব নিপীড়ন করে মার্ডারের মতো ঘটনাকে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মীমাংসা করার মানে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট অপরাধের সাথে জড়িতদের উৎসাহিত করা ও একই রকম অপরাধ বারবার করার জন্য তাদেরকে সুযোগ করে দেওয়া। সুতরাং এমন ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্তের মাধ্যমে মৃত্যু রহস্য উন্মোচন করে দোষীদের গ্রেফতার, এবং আইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই কেবল মব নিপীড়ন ও হত্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব' বলেও মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান (ক্রিমিনোলজি) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান শাহারিয়া আফরিন।

(আরআর/এএস/জুন ১৮, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

৩১ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test