ঐতিহ্যবাহী মোহন্ততলার মেলা, মিলন আর কিংবদন্তির এক অসাধারণ আখ্যান

স্বাধীন মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ, যশোর : যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার খেদাপাড়া ইউনিয়নের বুকে, হরিহর নদের তীরে অবস্থিত রঘুনাথপুর মহাশ্মশান। এই পুণ্যভ‚মিতে প্রতি বছর আষাঢ় মাসের ৮ তারিখে বসে ‘মোহন্ততলার মেলা’ এক অসাধারণ মিলনমেলা । প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো এই মেলা শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের এক মিলনক্ষেত্র। মানুষের সঙ্গে মানুষের এই দুর্লভ মিলনকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন তার অমর পঙ্ক্তিমালায় গেঁথে রেখেছেন “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে / এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।”
সোমবার (২৩ জুন) দুপুরে রঘুনাথপুর মহাশ্মশানে প্রবেশ পথেই দেখা যায় জোড়া মূর্তির মাতৃ স্মৃতি মন্দির। মন্দিরের ভেতরের দেয়ালে সারি সারি শিবশঙ্কর, মহর্ষি বাল্মীকি, দেবব্যাস, রাধাকৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধ, যীশু খ্রিস্ট, পরমহংসদেব, করিচাঁদ ঠাকুর, ঠাকুর অনুক‚ল চন্দ্রসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি শোভা পাচ্ছে। পুরাতন বটগাছের নিচে বসেছে কীর্তনের আসর। ছোট-বড় সকল ভক্তের কপালে লম্বা করে তিলক লাগানো। আশ্রমের বাইরে বসেছে হরেক রকম খাবারের দোকান। ভক্তদের জন্য রান্না করা হচ্ছে সবজি খিচুড়ি। বেলা গড়িয়ে দুপুর পার হতেই প্রচুর লোকের সমাগম শুরু হয়। সবুজ শ্যামলা গ্রাম বাংলার মনোমুগ্ধকর পরিবেশে কীর্তনের সুর ভেসে আসে। যা এক অন্যরকম পবিত্র ও শান্তিময় পরিবেশ তৈরি করে।
মোহন্ততলার মেলা শুধু একটি বাৎসরিক উৎসব নয়। এটি বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির এক প্রতিচ্ছবি। এই মেলা মানুষের মাঝে এনে দেয় মিলন ও একতার বার্তা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলবে বলে আশা করা যায়।
মোহন্তমেলা উপলক্ষে রঘুনাথপুর মোহন্ততলা আশ্রমে আয়োজন করা হয়েছে দিনব্যাপি কীর্তন ও সংগীতানুষ্ঠান, ধর্ম ও মানবতা বিষয়ক আলোচনা ও প্রসাদ বিতরণ।
মেলায় আসা অশুতোষ বিশ্বাস বলেন, প্রতিবছর এই মেলার আয়োজন করা হয়। দূর দূরন্ত থেকে ভক্তরা আশ্রমে আসেন। পূজা আর্চনা করেন। প্রাচীন এই মেলা ঘিরে সকল ধর্মের মানুষের আগ্রহ কাজ করে।
সুমতি দাস বলেন, বহু বছর ধরে আষাঢ মাসের ৮ তারিখে এখানে মেলা বসে। এলাকার যারা বাইরে থাকেন তারা বাড়িতে আসেন। মেলা আগে জাকজমক হত। সময়ের সাথে সাথে মেলার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আশা করি মোহন্ততলার মেলা তার পুরানো ঐতিহ্যে ফিরবে।
রঘুনাথপুর মোহন্ততলা আশ্রমের উপদেষ্টা অধ্যপক সত্য রঞ্জন সরকার বলেন, ‘এই মেলার সূচনা হয়েছিল এক মহাজ্ঞানী সাধক, গিরিধর মহারাজকে কেন্দ্র করে। প্রায় দুই শত বছর আগে মণিরামপুর উপজেলার এড়েন্দা গ্রামের (বর্তমানে গোয়ালদাহ বাজারের পাশে) গিরিধর বাল্যকালে বিয়ে করেও সংসার ত্যাগ করে সাধনার পথে পা বাড়ান। ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থভ‚মি ঘুরে অবশেষে আসামের কামরূপ কামাখ্যায় তিনি তান্ত্রিক গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘ বারো বছর ধরে কঠোর সাধনা ও তন্ত্রশিক্ষার পর তিনি ‘মহারাজ’ উপাধিতে ভ‚ষিত হন।
এদিকে, হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, স্বামী যদি দীর্ঘ ১২ বছর স্ত্রীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন এবং কোনো সংবাদ থাকে না। তবে তার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। ঠিক সেই সময়ে নিজ জন্মভ‚মিতে গিরিধরের শ্রাদ্ধের আয়োজন চলছিল। শোকের আবহের মধ্যেই হঠাৎ দীর্ঘ জটাধারী এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ঘটে। তিনি জেনেছিলেন যে গিরিধারীর শ্রাদ্ধ হচ্ছে। এই সংবাদ শুনে সন্ন্যাসী নিজ গৃহে প্রবেশ না করে সোজা হরিহর নদের পথে বজরায় করে ঘন জঙ্গলে ঘেরা গরীবপুর মহাশ্মশানে চলে আসেন।
সেই সময়ে শ্মশানের চারপাশ ছিল জনমানবহীন, ঘন বনজঙ্গলে ঢাকা। দিনের বেলাতেও কেউ সেখানে যেতে সাহস করত না। শিয়াল, চন্দ্রবোড়া সাপ, অজগর, এমনকি বাঘ ও বুনো শুয়োরের বিচরণক্ষেত্র ছিল এটি। সন্ন্যাসী গিরিধারী মহারাজ এখানেই তার আস্তানা গড়েন।’
এলাকাবাসি সুত্রে জানা গেছে, শুরুর দিকে এই ভীতিকর নির্জন পরিবেশে শবদাহের জন্য আসা লোকজন মাঝে মাঝে হরিবোল শব্দ শুনে বড় বড় কচ্ছপ আর গজাল মাছ ছুটে আসতে দেখত। কারণ, অনেক সময় শবদেহ সম্পূর্ণরূপে না পুড়িয়ে কচুরিপানার নিচে ফেলে দেওয়া হত। যা এই জলজ প্রাণীদের আকর্ষণ করত। এই পরিবেশে সন্ন্যাসী প্রায়শই শব সাধনায় লিপ্ত হতেন। বিশেষ করে শনি বা মঙ্গলবারে অমাবস্যা পড়লে তান্ত্রিক মতে সাধনা করতেন।
ধীরে ধীরে দু-একজন উৎসুক মানুষ জটাধারী সাধুবাবার কাছে যাতায়াত শুরু করেন। নির্বাক দৃষ্টিতেই তাদের ভাব বিনিময় হতো। তখন ডাক্তার বা কবিরাজ না থাকায় মানুষ রোগ-মুক্তির জন্য ফকির, গুণিন, সাধু-সন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হতো। জলপড়া, তেলপড়া, তুকতাক ও ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাসে ভর করে তারা রোগমুক্তির আশায় আসত।
জনশ্রুতি আছে, একসময় কলেরা রোগের প্রাদুর্ভাবে গরীবপুর গ্রামের হিন্দু মাহিস্য দাসপাড়ার প্রায় সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিল। গ্রামের যারা বেঁচে ছিলেন, তারা সাধু মহারাজের কাছে ছুটে আসেন। সন্ন্যাসী তখন তান্ত্রিক মতে সাধনা করে তাদের সুস্থ করে তোলেন এবং তাদের নিজ বাসস্থান ত্যাগ করতে বলেন। সেই থেকে গরীবপুর গ্রাম হিন্দশুন্য হয়।
পাশের মামুদকাটি গ্রামের ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও মারাত্মক অসুখ থেকে সুস্থ হন সন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হয়ে। এই খবর দ্রæত ছড়িয়ে পড়লে সন্ন্যাসীর অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি মানুষের বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করে। আশেপাশের লোকজনের রোগবালাই দূর হতে শুরু করে। শ্মশানের কাছেই তাকে ঘিরে খড়ের ঘর এবং তালপাতার ছাউনি দিয়ে মাতৃসাধনার জন্য মন্দির গড়ে তোলা হয়।
এলাকার বাদল বিশ্বাস, নফর সরকার, ইয়াসিন বিশ্বাসসহ অনেকেই সন্ন্যাসীর কাছে যাতায়াত শুরু করেন। তার অলৌকিক ক্ষমতা এবং রোগ সারানোর গুণ দূর-দূরান্ত থেকেও রোগীদের আকর্ষণ করে। সন্ন্যাসীর জন্য ফলমূল, দুধ, চাল, তরিতরকারি ইত্যাদির অভাব রইল না। রোগমুক্ত হয়ে সবাই সন্ন্যাসীর গুণগানে পঞ্চমুখ হতে শুরু করে।
রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে তাদের দেখাশোনার ভার অর্পিত হয় রঘুনাথপুরের নফর সরকার, বাদল বিশ্বাস ও ইয়াছিন বিশ্বাসের উপর। তৎকালীন মানুষ জমিজমা, ফসল বা অর্থ-সম্পদের প্রতি উদাসীন ছিল বলে সন্ন্যাসীকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করার জন্য লোকের অভাব ছিল না।
একসময় সন্ন্যাসীর খবর লোকমুখে তার স্ত্রীর কাছে পৌঁছায়। একদিন তার স্ত্রী ষোলো বেহারার পাল্কিতে চড়ে শ্মশানের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সন্ন্যাসী তান্ত্রিক ধ্যানে এই খবর জানতে পারেন। তিনি শিষ্যদের সেদিন গভীর জঙ্গলের ভেতরে থাকতে নির্দেশ দেন। যখন পাল্কি শ্মশানের কাছাকাছি পৌঁছায়, তখন শ্মশানের চারপাশ, রাস্তা, গাছপালা শকুন আর শকুন দ্বারা ভরে যায়। তিল ধারণের জায়গা ছিল না। সন্ন্যাসীর সেদিন ছিল এক উগ্র মূর্তি। সবাই ভয়ে কম্পমান। বেহারারা কোথাও পাল্কি রাখার জায়গা না পেয়ে সন্ন্যাসীর স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
এরপর সন্ন্যাসী লোক মারফত খবর পাঠান, “যদি তিনি কোনোদিন তার স্ত্রীর মুখদর্শন করেন, তাহলে তাঁর মৃত্যু হবে।” এই খবর শোনার পর তার স্ত্রী আর কখনো তার দেখা করতে আসেননি। এক স্ত্রীর প্রত্যাশা এবং এক সাধকের আত্মত্যাগের এই কিংবদন্তি মোহন্ততলার মেলার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
(এসএমএ/এএস/জুন ২৪, ২০২৫)
পাঠকের মতামত:
- ‘আ.লীগ দেশের জন্য রাজনীতি না করে ভারতের তাবেদারি করেছে’
- শ্যামনগর বিএনপি’র একাংশের বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ
- কুষ্টিয়ায় জিকে খালে মিলল অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ
- প্লট জালিয়াতি, শেখ হাসিনা-জয়-পুতুলের বিচার শুরু
- ‘আমরা এমন জাতি নিজেদের সন্তানদেরও পুড়িয়ে মারি’
- ‘শেখ হাসিনাকে ১০ বার ফাঁসিতে ঝোলালেও তার অপরাধ কমবে না’
- ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭১ লাখ ৩৩ হাজার ৪ জন
- নিজেকে বাঁচাতে মাকে দিয়ে বাদির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা সন্ধিগ্ধ আসামী রফিকুলের!
- জেলা প্রশাসকের বাসভবনে হামলার ঘটনায় ১০১ জনের বিরুদ্ধে মামলা
- আরবি লেখা শেখার ছলে ঘরে নিয়ে শিশুশিক্ষার্থীকে ধর্ষণ, ধর্ষক গ্রেফতার
- সাত উপাচার্যের অংশগ্রহণে গোপালগঞ্জ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ম ব্যাচের 'শিক্ষা সমাপনী
- হৃদরোগে আক্রান্ত জামায়াত আমির, বাইপাস সার্জারির পরামর্শ
- ‘৫ আগস্ট ঘিরে কোনো নিরাপত্তা শঙ্কা নেই’
- ‘সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে ফ্যাসিস্ট মাথাচাড়া দিতে পারে’
- শ্রীনগরে অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালে চলছে স্বাস্থ্য সেবা
- হাসিনাকে দেশে ফেরাতে আ.লীগের নতুন পরিকল্পনা
- ‘গাজীপুরে আসন বাড়বে, কমবে বাগেরহাটে’
- ডেঙ্গুতে আরও ২ মৃত্যু, হাসপাতালে ৩৮৬ জন
- ১০২ এসিল্যান্ড প্রত্যাহার
- জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের দাবি ঐক্য পরিষদের
- ‘তিন মাসে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন হয়েছে, এক বছরেও না হওয়ার কারণ দেখছিনা’
- পাংশায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ
- স্কুলছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে শাহীন গ্রেপ্তার
- জামালপুরে দুই টিকিট কালোবাজারি আটক
- গোপালগঞ্জে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ
- ‘কোন মানুষ অর্থের কাছে চিকিৎসায় হেরে যাবে না, সবাই বাঁচবে’
- রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় প্রাণ গেল ৩ মোটরসাইকেল আরোহীর
- ঝিনাইদহে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ কর্মী নিহতের ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি
- প্রজন্মের কাছে এক মুক্তিযোদ্ধার খোলা চিঠি
- প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি, বিএনপি নেতা চাঁদের নামে মামলা
- মা
- পারিবো না
- ঝিনাইদহে বজ্রপাতে মৃত দুই কৃষক পরিবারকে তারেক রহমানের মানবিক সহায়তা প্রদান
- অতিরিক্ত ঠান্ডায় ঠাকুরগাঁওয়ে বেড়েছে শিশু রোগীর সংখ্যা
- রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করছে জান্তা
- লক্ষ্মীপুরে গুলিবিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু
- লক্ষ্মীপুরে বাংলা নববর্ষ উদযাপন
- নৌকার পক্ষে সমর্থন জানানেল এডভোকেট আব্দুল মতিন
- লক্ষ্মীপুরে দোকান ঘর বিক্রির নামে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা
- রুমা-থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি: ১৭ নারীসহ ৫২ জন রিমান্ডে
- মহুয়া বনে
- সাংবাদিক নাদিম হত্যার প্রতিবাদে শেরপুরে প্রতিবাদ সমাবেশ
- বিজনেস সামিটের পর্দা নামছে আজ
- রামগঞ্জে ইমতিয়াজ ও রায়পুরে অধ্যক্ষ মামুন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত
- ‘শেখ হাসিনাকে ১০ বার ফাঁসিতে ঝোলালেও তার অপরাধ কমবে না’
৩১ জুলাই ২০২৫
- শ্যামনগর বিএনপি’র একাংশের বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ
- কুষ্টিয়ায় জিকে খালে মিলল অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ
- নিজেকে বাঁচাতে মাকে দিয়ে বাদির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা সন্ধিগ্ধ আসামী রফিকুলের!
- জেলা প্রশাসকের বাসভবনে হামলার ঘটনায় ১০১ জনের বিরুদ্ধে মামলা
- আরবি লেখা শেখার ছলে ঘরে নিয়ে শিশুশিক্ষার্থীকে ধর্ষণ, ধর্ষক গ্রেফতার