E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা পৗরসভায় জলাবদ্ধতা

অনেক জায়গায় যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন ভেলা 

২০২৫ জুলাই ০৭ ১৮:৫৩:৩৭
অনেক জায়গায় যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন ভেলা 

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : টানা তিন দিনের মুষলধারায় বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ডে জলবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বসতবাড়ি, রান্নাঘর ও গোয়ালঘরে পানি উঠেছে। ডুবে গেছে টিউবওয়েল। সুপেয় পানি সংকটের পাশাপাশি ভেঙে পড়েছে স্যানিটেশন ব্যবস্থা।

সরেজমিনে গত রবিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সাতক্ষীরা পৌরসভার কামালনগর, ইটাগাছা, পলাশপোলের মধুমোল্লারডাঙি, মেহেদীবাগ, রসুলপুর, বদ্দীপুর কলোনি, রইচপুর, মধ্য কাটিয়া, মুনজিতপুরের রথখোলা, রাজার বাগান, গদাইবিল, মাঠপাড়া, পার-মাছখোলা ও পুরাতন সাতক্ষীরার নিম্ম এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সাত নম্বর ওয়ার্ড ও নয় নম্বর ওয়ার্ডের অবস্থা ভয়াবহ। রাস্তার উপর হাঁটুপানি থাকার কারণে ভাঙা ককশিট নেটে ভরে বানানো ভেলা দিয়ে মানুষজন যাতায়াত করছে। টিউবওয়েল ডুবে গেছে। ঘরে, বারান্দায় ও রান্না ঘরে পানি উঠেছে। অনেকেই সুপেয় পানির অভাব, সাপের ভয়, রান্না করতে না পারা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বাড়ি ছেড়েছেন। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পড়েছে বিপাকে।

পৌরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের ইটাগাছা বিলপাড়ার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম খোকা জানান, বুধবার রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত টানা হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় তাদের এলাকাসহ পৌরসভার নয়টি ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকা। ইটাগাছার বিলে অপরিকল্পিত মৎস্য ঘেরের কারণে পানি খাল দিয়ে নদীতে পড়তে পারছে না। বাইপাস দিয়ে যে স্লুইজ গেট দিয়ে পানি নিষ্কাশন হওয়ার কথা তার মুখ ও বন্ধ হয়ে গেছে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোয়াইব আহমাদ ইটাগাছা বিলে এসে ঘের মালিকদের তিন দিনের মধ্যে অবৈধ নেটপাটা সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্দেশনা অনুযায়ি কাজ হলে পানি বাইপাস সড়কের নীচ দিয়ে নদীতে পড়লে জলাবদ্ধতা কমবে।

বদ্দিপুর কলোনী এলাকার গৃহিনী সাজেদা বেগম জানান, পৌরসভার ট্যাক্স দেন নিয়মিত। অথচ বৃষ্টি হলেই দীর্ঘ ১০ বছর ধরে তিন নং ওয়ার্ডে যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় তারন নিরসনের উদ্যোগ নেয়না পৌরসভা। ফলে প্রতিবছরের ন্যয় এবারও সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে তাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটু পানি জমেছে। রান্না ঘরে ঢুকেছে পানি। হাঁড়ি জ্বালা বন্ধ। ঘরের মধ্যে সাপ-মাকড়সা বাসা বেঁধেছে। দিনের বেলায় কোন রকমে বাড়ি থাকলেও রাতে সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র রাত কাটান।

ওই এলাকার মাদ্রাসা ছাত্র শাহিনূর রহমান জানান, মাদ্রাসার সামনের রাস্তায় পানি। হাঁটু সমান পানি ঠেলে তিন বেলা খেতে যেতে হয়। কোন কিছু কিনতে বাজারে যেতে হলে সমস্যার অন্ত থাকে না। পারমাছ খোলার আমিনুর হোসেন জানান, সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে তাদের এলাকার নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছ। পানির নীচে সবজি খেত।

শহরের পার কুখরালি এলাকার বাসিন্দা শিমুল হোসেন জানান, পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের কুখরালী উত্তরপাড়ার প্রধান রাস্তাটির দু’পাশের তিন শতাধিক পরিবার সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। শহরের ইটাগাছা, গড়েরকান্দা, কুখরালী ও বাঁকাল বারুইপাড়া এলাকার পানি আসে যে বিলে, সেই বিলের পানি বেরোনোর পথ বন্ধ করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালী ঘের মালিকরা। বছরের ছয় মাসের ও বেশি সময় ধরে সাত বছর যাবৎ মানুষ এ দূরাবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। পৌর মেয়র ও কাউন্সিলররা ভোটে জিতে সমস্যার সমাধানের কথা বলে গেলেও ভোট শেষে কারো দেখা পাওয়া যায় না। এখন তারা বলেন, গত বছরের ৫ আগষ্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর পালিয়েছে ঠিকাদাররা। তাই নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ না হলে খাল কাটা ও কালভার্ট নির্মাণ করা যাচ্ছে না। সমাধান হচ্ছে না জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান।

ঘুটেরডাঙির আব্দুল গফুর বলেন, সাতক্ষীরা-আশাশুনি সড়কের পূর্বপাশে রামচন্দ্রপুর বিলের পানি উঠেছে উঠোনে। বেশ কয়েকটি বাড়িতে ও রান্না ঘরে পানি ওঠায় তারা সাপের ভয়ে বাড়ি থাকেন না। গবাদি পশুর থাকা ও খাওয়ার কষ্ট হওয়ায় আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাতক্ষীরা পৌরসভার জলাবদ্ধতা মানুষের সৃষ্ট বলে দাবি করে তিনি বলেন, ক্রমশঃ এটি মানবিক সংকটে রুপ নিচ্ছে।

সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষার্থী পলাশপোল মেহেদীবাগের শারমিন আক্তার জানান, বুধবার থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় বাড়ি থেকে বের হওয়ার রাস্তায় হাঁটু পানি জমেছে। কয়েকদিনে গাছপালা ও জীবজন্তু পঁচে দুর্গন্ধ শুরু হয়েছে। পানি শরীরে লাগতেই চুলকাচ্ছে। টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় কেনা পানি বা দূর থেকে পানি এনে ব্যবহার করতে হচ্ছে। দেখা নেই পৌরসভার কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের। যথাসময়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে।

সাতক্ষীরা জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. সুধান্য সরকার জানান, শহরের রসুলপুরের পুলিশলাইন সড়কটি পানিতে ডুবে গেলেও শনিবার বৃষ্টি না হওয়ায় কিছুটা পানি কমেছ। তবে ডুবে রয়েছে অলি- গলি।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে খনন করা নদী ও খালগুলোতে রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল পানি নিষ্কাশনের পথ সচল রাখা। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে তলদেশ কম কেটে পাড় উঁচু করে কৃত্রিম গভীরতা দেখানো হয়েছে। খালের প্রশস্ত কমানো হয়েছে। যার ফলে বর্ষার পানি নদীতে না গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে লোকালয়ে জমে থাকছে। এমনকি নদীর পানিও মাঝে মাঝে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।

সাতক্ষীরা নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, সাতক্ষীরা পৌরসভার আয়তন ৩১ দশমিক ১০ বর্গ কিলোমিটার। এখানকার জনসংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ মাঠের দক্ষিণ পাশ থেকে জিয়া হল পর্যন্ত রাস্তার উপর হাঁটু পানি। বছরের পর বছর এই জায়গায় পানি জমে থাকে। ফলে বর্তমানে সেখানে পিচ ও খোয়া উঠে খানা খন্দে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া জুন মাসের প্রথম থেকে পোষ্ট অফিস মোড় থেকে পুরাতন সাতক্ষীরা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ায় সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে মানুষ ও যানবাহন চলাচলে দুর্ভোগ বেড়েছে। বেতনা নদীর সঙ্গে যুক্ত সকল স্লুইজ গেট খুলে দেওয়া ও অপরিকল্পিত ঘেরের পাশে বসানো সকল নেট পাটা সরকারিভাবে অপসারণ, প্রকৃত গভীরতা ও সাবেক ম্যাপ অনুযায়ি সকল নদী ও খাল খননের দাবি জানান তিনি। বিকল হয়ে পড়ে থাকা স্লুইজ গেট সংস্কার ও ত্রুটিপূর্ণ বাঁধ সংস্কারের ও দাবি জানান তিনি।

সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের উচ্চমান সহকারী জুলফিকার আলী রিপন জানান, বুধবার বিকেল থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। রবিবার দুপুর থেকে আবারো হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাতে ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শোয়াইব আহমাদ বলেন, সাম্প্রতিক তিন থেকে চার দিনের বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা পৌরসভার সাত ও নয় নম্বর ওয়ার্ডসহ সদর উপজেলার বেশ কিছু অঞ্চল জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। গত ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে উপজেলার বাজেট থেকে ৫০ কিলোমিটার সেচনালা ও খাল সংস্কার করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কালভার্ট। বেতনা নদী খনন চলমান রয়েছে। পারশাল্যে ও কুঞ্জোডাঙির স্লুইজ গেট খুলে দেওয়া হবে। শহরের উপর দিয়ে প্রবাহমান প্রাণসায়ের খালে পৌরসভার পানি ফেলতে পারলে জলাবদ্ধতা কমে যাবে।

(আরকে/এসপি/জুলাই ০৭, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

৩০ জুলাই ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test