E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

অথর্ব প্রশাসনে বাড়ছে বন্য ও জলজ প্রাণী হত্যা

২০২৫ আগস্ট ২৪ ১৮:২৪:৫৩
অথর্ব প্রশাসনে বাড়ছে বন্য ও জলজ প্রাণী হত্যা

শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : কুমির, শুশুক, মেছো বাঘ,কিংবা গন্ধ গোকুল। কোন বন্য প্রাণীই ধরা বা হত্যা বাদ পড়ছে না এ এলাকার মানুষের হাত থেকে। চোখের সামনে মিললেই ফাঁদ পেতে, তাড়া করে এসব প্রানী ধরা হচ্ছে। পিটিয়ে মেরে তা ঘাড়ে ঝুলিয়ে করা হচ্ছে উল্লাসও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা হচ্ছে লাইভ ও পোস্ট। খবর পেয়ে ভীড় করছে উৎসুক জনতা। তাদের সামনেই এসব জলজ ও বন্যা প্রানীকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। তবে বাধা দিচ্ছে না কেউ। উল্টো হত্যাকান্ডে অংশ নিচ্ছেন তারা। শুধু এসব প্রানীই নয়, সাপ, বেজি, গুইসাপ, বক, পানকৌড়িও এ এলাকার মানুষের কাছে চরম শত্রু। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মানুষের কাছে বন্য ও জলজ প্রানী নিধন যেন শিল্পে রুপ নিয়েছে।

একের পর এক এসব প্রানী হত্যা হলেও স্থানীয় বন বিভাগ ও প্রশাসন নির্বিকার। যেন চোখে লাগিয়েছে কাঠের চশমা, কানে গুজেছে তুলা। একাধিক হত্যাকারীদের ছবি, ভিডিও থাকলেও কোনপ্রকার আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে। এমনকি জনসাধারণকে সচেতন করতেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়না। শুধু তা-ই নয়, গত কয়েক বছরে কতগুলো বন্য ও জলজ প্রানী হত্যা হয়েছে সেই তথ্যও নেই স্থানীয় বন বিভাগের কাছে।

বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ কার্যকর রয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, যেকোনো বন্যপ্রাণী হত্যা, শিকার বা তাদের বাসস্থান ধ্বংস করা একটি গুরুত্বর অপরাধ। এই আইনের ধারা ৩৮ (১) অনুযায়ী, সংরক্ষিত বন্যপ্রাণী হত্যা বা শিকার করলে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদ- অথবা সর্বোচ্চ এক লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। তবে সচেতনতার অভাব ও আইনের প্রয়োগ দুর্বল হওয়ার কারণে এ এলাকায় অপরাধ থামছেই না।

কয়েক বছর ধরে শৈলকুপা উপজেলায় একের পর এক ঘটে চলেছে এমন অমানবিক ঘটনা। খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে এসব প্রাণীরা যখন বিপন্ন হয়ে লোকালয়ে আশ্রয় চাইছে, তখন স্থানীয়দের হিংস্র আক্রমণে মারা যাচ্ছে তারা। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় প্রশাসন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মীদের নীরব ভূমিকা পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে।

সম্প্রতি শৈলকুপার হাকিমপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে খাবারের খোঁজে একটি বিলুপ্তপ্রায় কুমির রাতে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। স্থানীয়দের কাছে সে আশ্রয় না পেয়ে শিকার হয় নির্মমতার। উত্তেজিত জনতা কুমিরটিকে পিটিয়ে ভ্যানে করে শৈলকুপা থানায় নিয়ে আসে। পরে পুলিশের হেফাজতে রেখে রাতেই তা খুলনা বন অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই ঘটনার এক মাস না পেরোতেই গড়াই নদীতে জেলেদের জালে আটকে পড়ে একটি শুশুক। পানি থেকে ডাঙ্গায় ওঠাতেই কিছুসময় পর শুশুকটি মারা যায়। সবশেষ, পৌরসভার সাতগাছিতে ঘটে আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা। একটি মেছোবাঘ ধানের ক্ষেতে আশ্রয় নিলে ধান কাটা মেশিনে গুরুতর আহত হয়। আহত অবস্থায় স্থানীয় জনগণ তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। পরে তা ঘাড়ে ঝুলিয়ে উল্লাস করতে থাকে এলাকাবাসী। করা হয় ফেসবুক লাইভও। এভাবে একের পর এক বিরল প্রজাতির প্রাণী হত্যার ঘটনা স্থানীয় পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। গত কয়েক বছরে এসব প্রানী হত্যার ঘটনা হাজারো ছাড়িয়েছে।

সচেতন মহল বলছেন, স্থানীয় বন বিভাগ ও প্রশাসনের দায়িত্বহীনতায় বাড়ছে এই হত্যাকান্ড। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে পোস্টারিং,মাইকিং কিংবা সভা-সমাবেশ প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সিনিয়র সাংবাদিক বিমল কুমার সাহা বলেন, ‘আইনে বন্য ও জলজ প্রানী হত্যা নিষিদ্ধ থাকলেও একের পর এক এসব প্রানী হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন এগুলোর খোঁজ রাখে না। প্রানীগুলো রক্ষায়ও কোন কোন ব্যবস্থা নেয়না। এ অবস্থা চলতে থাকলে এসব প্রানী বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’

তাজনুর রহমান ডাবলু নামে আরেক সাংবাদিক বলেন, ‘বিলুপ্তপ্রায় এসব প্রানী রক্ষায় বন বিভাগ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে পোস্টারিং, মাংকিং, সভা-সমাবেশের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে জনসাধারণ সচেতন হয়।’

সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংবাদিক আলমগীর অরণ্য বলেন, ‘একাধিক হত্যাকারীদের ছবি-ভিডিও থাকলেও স্থানীয় প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। যার ফলে দিন দিন এমন ঘটনা বেড়েই চলেছে। হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করলেই এমন ঘটনা কমে যাবে।’

প্রাণ-পরিবেশ-প্রতিবেশ সংগঠক সুজন বিপ্লব বলেন, ‘বন্য ও জলজ প্রাণী নির্বিচারে হত্যার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। উন্মত্ত মবের হাতে ধারাবাহিকভাবে গন্ধগোকূল, কুমির, শুশুক সহ বন্য ও জলজ প্রাণী নির্বিচারে হত্যার শিকার হলেও জনগণকে সচেতন করতে কোনো ধরণের প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেই। মানুষের বাসযোগ্য আবাসভ’মির প্রয়োজনে এসব জীববৈচিত্র ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী বন্যা ও জলজ প্রানীগুলো সংরক্ষণ করা দরকার। এসব প্রানী হত্যা বন্ধে প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

জনবল সংকট ও পর্যাপ্ত ট্রেইনিং না থাকার দোহায় দিয়ে শৈলকুপা উপজেলা বন কর্মকর্তা মোকলেচুর রহমান বলেন, ‘সংকটের কারণে আমরা মাঠপর্যায়ে সবসময় কার্যকরভাবে কাজ করতে পারি না। এত বড় উপজেলায় বনভূমি ও প্রানী রক্ষার দায়িত্ব এত অল্প জনবলের কাঁধে চাপানো হয়। প্রশিক্ষিত জনবল না থাকায় অনেক সময় বন্যপ্রাণী রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। আমরা চাই পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ হোক, আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। তাহলেই প্রকৃতপক্ষে বন ও বন্য ও জলজ প্রানী সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এসব প্রানী ধরা ও হত্যা বন্ধে জনসচেতনতা বাড়তেও শ্রীঘ্রই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্নিগ্ধা দাস বলেন, ‘জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রানী হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনতে বন বিভাগকে সকল প্রকার সহযোগিতা করা হচ্ছে। শুধু প্রশাসন না, প্রানী হত্যা বন্ধে সচেতন মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।’

(এসআই/এসপি/আগস্ট ২৪, ২০২৫)

পাঠকের মতামত:

২৪ আগস্ট ২০২৫

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test